• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতির দৃশ্যপটে পরিবর্তন


বিশেষ প্রতিনিধি নভেম্বর ৫, ২০১৮, ১০:০৯ পিএম
রাজনীতির দৃশ্যপটে পরিবর্তন

ঢাকা : সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী ৮ নভেম্বর এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই কওমি আলেমরা কট্টর আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থানে ছিলেন। তবে এই মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়ায় পুরো চিত্রই পাল্টে গেছে।

কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের শোকরানা সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করাটা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীকে কওমি আলেমদের সংবর্ধনায় সেটা আবার প্রমাণ হলো। কারণ, তাদের সঙ্গে একসময় আওয়ামী লীগের ব্যাপক দূরত্ব ছিল। এই আলেমরা সাধারণত বিএনপিকে ভোট দিত। তারা এখন আওয়ামী লীগকে হয়তো ভোট দেবে। এটা আওয়ামী লীগের জন্য একটা বড় অর্জন বলা যায়। নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি।’

সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘হেফাজতের সঙ্গে আগে আওয়ামী লীগের একরকম সম্পর্ক ছিল। এখন অন্য রকম। রাজনীতি এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে হেফাজতের সঙ্গে সখ্য গড়েছে।’

শোকরানা সমাবেশে কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের সর্বোচ্চ নেতা আল্লামা আহমদ শাহ শফী ভ‚য়সী প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রীর। তার বাবাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন করে বলেছেন, তিনি দেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আর তার মেয়ের হাত দিয়ে লাখ লাখ কওমি আলেমের স্বপ্ন সফল হয়েছে।

শোকরানা সমাবেশে বিএনপির সঙ্গে প্রায় দেড় যুগ জোটবদ্ধ থাকা ইসলামী ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক হেফাজত নেতা মুফতি মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ ‘মহীয়সী নারী’ বলেন শেখ হাসিনাকে। যদিও তিনি বরাবর আওয়ামী লীগ নেত্রীর কট্টর সমালোচকদের একজন ছিলেন।

সমাবেশে শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ বলেও আখ্যা দেয়া হয়। আর এই ঘোষণায় পড়ে তুমুল হাততালিও।

মনোভাবে কেন এই বদল- এমন প্রশ্নে মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘আমি এভাবে বলি, কেউ যদি ভালো কাজ করে, তাকে ভালো কাজের স্বীকৃতি দেই। কেউ অন্যায় করলে প্রতিবাদ করি। এর নাম আলেম ওলামা। সারা দেশের ওলামা একরামের স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী বাস্তবায়ন করেছেন। আলেম ওলামারা খুশি হয়েছেন, খুশি থাকলেই সম্পর্ক বাড়ে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাকিস্তান আমলের শুরুতে জš§ নেয়া আওয়ামী লীগ ১৯৫৪ সালে যখন প্রথম নির্বাচনে যায়, তখন অবশ্য কওমি আলেমদের একটি বড় অংশ এই দলটির সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল। গঠন করা যুক্তফ্রন্টের শরিক ছিল নেজামে ইসলাম পার্টি, যাদের নেতারা ছিলেন প্রধানত কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলামা।

তবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আর নেজামে ইসলামের সঙ্গে জোটে যায়নি আওয়ামী লীগ বরং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় যেসব ধর্মভিত্তিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাদের মধ্যে নেজামে ইসলাম পার্টিও ছিল।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার দুই বছর পর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাতিল করা হয়। তবে এই মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকরা সে সময় এই স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে তেমন ভাবতেন না। বরং আবার রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে বিএনপির ঘনিষ্ঠ হয়ে যান আলেম-ওলামারা।
এই আলেমরা আবার বরাবর জামায়াতে ইসলামীর কট্টরবিরোধী। দলটির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একে ইসলামীবিরোধী আখ্যা দিয়ে বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
তবে ১৯৯৯ সালে বিএনপির পাশাপাশি এই জামায়াতের সঙ্গেই তারা জোটবদ্ধ হন। সে সময় কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতির আশ্বাসেই এই ‘ছাড়’ দেন ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে কওমি আলেমরা। বিএনপির শাসনামলের একেবারে শেষের দিকে এই সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা এলেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ নিয়ে এক ধরনের আক্ষেপ ছিল কওমি আলেমদের।

২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আল্লামা শফীসহ কওমি আলেমদের সে সময় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কওমি সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে আলোচনা হয় সেখানে, প্রধানমন্ত্রী কওমি আলেমদের এ বিষয়ে সুপারিশ দিতে আহ্বান জানান।

তবে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ কওমি আলেমরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সনদের স্বীকৃতি নেয়ার পক্ষে ছিলেন না। আর মূলত তাদের বিরোধিতায় ভেস্তে যায় সব উদ্যোগ।

তবে ২০১৬ সালের শুরুতে ইসলামী ঐক্যজোট ও বিএনপির সম্পর্কের অবসান ঘটার আগে থেকেই ধর্মভিত্তিক এই দলটির সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যোগাযোগ শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। আর এরপর প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতির উদ্যোগ এগিয়ে যায়।

যদিও ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামীর অবস্থান তুলতে অভিযান নিয়ে সে সময় নানা গুজবে কওমি ছাত্র-শিক্ষকদের মনোভাব ছিল বিরূপ। কিন্তু পরে তারাও ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন আর হেফাজত নেতারা ওই অভিযানে মৃত্যুর অভিযোগ তোলেন না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৩ সালেই পাঁচ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে যেসব অনুঘটক কাজ করেছিল, তার একটি ছিল কওমি আলেমদের আবেগী বক্তব্য। তবে পাঁচ বছর পর এবার পাঁচ সিটি নির্বাচনে এসব মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকরা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে কোনো বক্তব্য দিয়েছেন, এমনটি শোনা যায়নি।

কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রি দলগুলোর এমনিতে ধর্তব্যের মতো ভোট নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে ধর্মের মিশেলে বরাবর তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে, যার সুফল বরাবর আওয়ামীবিরোধীরা পেয়ে থাকে। এবারের পাঁচ সিটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা এবং সোহরাওয়ার্দীর শোকরানা সমাবেশের পর আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আর এই সমস্যায় পড়তে হবে না বলে আশা করছেন দলটির নেতারা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘এদেশে ইসলামের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ৭৫ পরবর্তী সময়ে ভুল ব্যাখ্যা সৃষ্টি করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিষয়ে। আমাদের বিরুদ্ধে এ বিভ্রান্তি তৈরি করেছিল বিএনপি-জামায়াত। যেসব বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল তা কেটে যাচ্ছে, এটা ইতিবাচক দিক।’

তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কল্যাণেও কাজ করেছেন। এটা আগামী রাজনীতির জন্য একটা ইতিবাচক দিক হয়ে থাকবে।’

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!