• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রপতির ভাষণ কেন এত জনপ্রিয় হয়?


শেখ আদনান ফাহাদ অক্টোবর ১৩, ২০১৮, ০২:৫৬ পিএম
রাষ্ট্রপতির ভাষণ কেন এত জনপ্রিয় হয়?

একটি ভাষণ বা একটি যোগাযোগ কখন সফল হয়? যোগাযোগকারী আসলে কী প্রত্যাশা করে? নিঃসন্দেহে বক্তা প্রত্যাশা করেন তাঁর কথা শুনে দর্শক সঠিক ও যথোচিত প্রতিক্রিয়া দেবেন। কার্যকর যোগাযোগ যতগুলো শর্তের উপর নির্ভর করে, তার মধ্যে বক্তব্যের স্বচ্ছ উপস্থাপন নিঃসন্দেহে প্রাথমিক ও অন্যতম প্রধান শর্ত।

দর্শক-শ্রোতার ভাষা জেনে নিজের কথা সে ভাষায় ঠিকভাবে বলতে পারলেই কার্যকর যোগাযোগ সম্ভব হয়। পরিষ্কার করে অনেকেই কথা বলেন, কেউ আবার রসাত্মক ঢঙে কথা বলতে পছন্দ করেন। রসে ভেজা কথা শুনে দর্শকের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া দেখে বলা যায়, যোগাযোগ কার্যকর হয়েছে।

বাংলাদেশের জীবিত পাবলিক স্পিকারদের মধ্যে কোন সন্দেহ নেই যে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ অন্যতম জনপ্রিয়। জরিপ করলে তিনি হয়ত সবার উপরের দিকেই থাকবেন। নানা সময়ে দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রপতিদের মধ্যে জনপ্রিয়তার জরিপ করলেও বর্তমান রাষ্ট্রপতি অন্যতম জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিবেচিত হবেন। স্পিকার থাকাকালীন তিনি সংসদকে দারুণ সব মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন। এমপিদের তর্ক-বিতর্কের মধ্যে এমন সব মজার কথা বলতেন, পুরো সংসদ এবং রেডিও-টেলিভিশনের দর্শক-শ্রোতারা হেসে গড়িয়ে পড়তেন।

যখন তিনি রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন অনেকেই হয়ত ভেবেছিলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি হয়ে আজীবন রাজনীতিবিদ আব্দুল হামিদ বদলে যাবেন বা বদলে যেতে বাধ্য হবেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, আব্দুল হামিদ ‘রাষ্ট্রপতি’ হয়েও তাঁর স্বভাবজাত ‘মজা করে’ কথা বলার ধরন বাদ দিলেন না। বরং নতুন ভূমিকায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে নানা সমাবর্তনে বক্তব্য দিতে গিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অনেকগুলো ভাষণের জন্ম দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ।

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলর এর ভাষণ শুনে সমবেত হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বড় বড় সমাবর্তন বক্তাদের কথা শুনে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী একঘেয়েমিতে হাঁপিয়ে উঠেন, হাই তোলেন কিংবা বিরক্ত হয়ে ঝিমুতে থাকেন। অন্যদিকে চ্যান্সেলর আব্দুল হামিদ যখন ভাষণ দেন, তখন কেউ যেন একটা শব্দটাও মিস করতে চান না। এর কারণ কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মত বড় বড় ডিগ্রি উনার নেই, কিন্তু পাবলিক স্পিকিং এ রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের জনপ্রিয়তার ধারেকাছে কি দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আছেন?

সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে সভাপতির ভাষণে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এর বক্তব্য আগের যে কোন বক্তব্যের মতই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি মহামান্যের ভাষণ নিয়ে অন্য আঙ্গিকেও কথা এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে ফেসবুকে দেখলাম, মহামান্যের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।

ভাষণে বলিউডের অভিনেত্রী প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার প্রসঙ্গ আনায়ও কেউ কেউ ভালো চোখে দেখেননি। তবে ইউটিউবে ঢুকে দেখলাম, সাধারণ মানুষ বরাবরেই মতই খুব মুগ্ধ হয়েছেন রাষ্ট্রপতির এই ভাষণ শুনে। উনি উনার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে রসবোধসম্পন্ন ভাষায়, শব্দ ও ঢঙে সিরিয়াস অনেকগুলো বিষয় নিয়ে এসেছেন বক্তৃতায়।

রাজনীতির দৈন্যদশা নিয়ে খুব গভীর তাৎপর্যসম্পন্ন কথা বলেছেন রাষ্ট্রপতি। উনি ‘বাউজ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর অঞ্চলে ভাইয়ের বউকে ‘বাউজ’ বলে। গরিব মানুষের অসহায়ত্বকে বোঝাতে ‘গরিবের বউ সবারই বাউজ’। রাষ্ট্রপতি বলেছেন , রাজনীতি এখন ‘গরিবের বাউজ’ হয়ে উঠেছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, রাজনীতি এখন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।

সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ীরা এখন রাজনীতিতে চলে আসছেন বলে তিনি উল্লেখ করে বলেন, রাজনীতিবিদদের এ বিষয়ে আশু দৃষ্টিপাত করতে হবে, নাহলে রাজনীতির জগত দিন দিন কলুষিত হয়ে পড়বে। রাজনীতিতে রাজনীতিবিদরা থাকতে না পারলে রাজনীতির জগতে যে পুঁজিপতি আর মুনাফালোভীরাই আধিপত্য বিস্তার করবে, আর তাতে যে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ হুমকির মধ্যে পড়বে সেটি বলাই বাহুল্য।

একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হয়ত অনেক কথা বলে, অনেক রেফারেন্স দিয়ে এ কথাটাই বলবেন, কিন্তু মানুষ তাতে মনোযোগ নাও দিতে পারেন। রাষ্ট্রপতি নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে খুব সহজে রাজনীতি নিয়ে এই দামি কথাটা বলেছেন।

পৃথিবীর বড় বড় পাবলিক স্পিকারগণ নিজেদের বক্তৃতার মধ্যে নানা ধরনের বিষয় নিয়ে এসে দর্শক-শ্রোতাদেরকে বিনোদিত করার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ একবার এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি হয়ে ভগ্নিপতির মত’ কথা বললে হবে না! রাষ্ট্রপতি হবার পর যে তিনি স্বাধীনতা হারিয়েছেন সেটিও তিনি বারবার মনে করিয়ে দেন। রাতে ঘুমালে দরজা লক করে ঘুমানো যায় না বলে এক ভাষণে উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘তাহলে বুঝেন কী সুখে আছি!’।

দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়া প্রসঙ্গে এক ভাষণে তিনি মজা করে বলেছিলেন, ‘আমার দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়া নিয়ে তরুণরা মনে হয় খুশি না, বুইড়াডা না গেলে তো রাস্তা ক্লিয়ার হইতেসে না!। নিজের স্ত্রীকে অত্যধিক ভালোবাসেন বলেই হয়ত প্রায় সব ভাষণে তিনি তাঁর প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। প্রতিদিন ইনসুলিনের পেছনে তাঁর স্ত্রীর প্রায় ১০০০ টাকা খরচ হয়ে বলে তিনি এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে সকালে ঝগড়া হয়ে গেল, তারে তো আমি খাওয়া-পড়া দিব কইয়া বিয়া করসিলাম, কিন্তু ইনসুলিন দিব তো বলি নাই’!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ভাষণেও তিনি স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার কথা বলেছেন। মাস কয়েক আগে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া জাতিসংঘের বিশেষ দূত হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সাথে রাষ্ট্রপতির বৈঠক তাঁর স্ত্রী ষড়যন্ত্র করে বানচাল করে দিয়েছেন বলে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অনুযোগ করেছেন রাষ্ট্রপতি। তরুণ-তরুণীদেরকে রাষ্ট্রপতি প্রেম-পত্র লেখারও পরামর্শ দিয়েছেন। চিঠি-সাহিত্য যে বাংলা সাহিত্যের দারুণ সম্পদ সেটি মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন রাষ্ট্রপতি। বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিপদের কথা তিনি তাঁর নিজের নাতির উদাহরণ দিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ নয় শুধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাও রাষ্ট্রপতির ভাষণে নিজেদের মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন।

মোবাইল ফোন আসার পর থেকে মানুষের মধ্যে যে সামাজিক বন্ধন বিঘ্নিত হচ্ছে সেটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন। গণমাধ্যমের বড় বড় তাত্ত্বিকগণ অনেক গবেষণা করে যে কথা বলতে পৃথিবী উলট-পালট করেন সে কথাটা তিনি খুব সহজে বলে ফেলেছেন রাষ্ট্রপতি। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা থেকে যে হতাশা আসে সেটা তিনি উপস্থাপন করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া কমিউনিকেশন বনাম রিয়েল কমিউনিকেশনের ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে গবেষণা চলছে।

আঞ্চলিক ভাষায় কথার বলা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও নিজের যুগান্তকারী প্রতিটি ভাষণে কিছু কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ উক্তির মধ্যে দাবায়ে একটি আঞ্চলিক শব্দ। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক পুরান ঢাকার ভাষায় কথা বলতেন বলে অন্যদের কাছে এবং লেখায় জেনেছি। সময়ের আলোকিত মানুষ প্রফেসর সলিমুল্লাহ খান এর কথায় চট্টগ্রামের টোন আসে। বাংলাদেশের খুব কম মানুষ আছেন যারা ‘মান’ বাংলায় কথা বলেন। পাবলিক স্পিকিং যে সবসময় তথাকথিত ‘মান ভাষা’ ব্যবহার করতে হবে সেটি অত্যাবশক নয়।

সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ভাষণ ইউটিউবে শুনে শিমরান পারভেজ নামে একজন মন্তব্য করেছেন ‘মন খারাপ থাকলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেখলে এমনিতেই মন ভাল হয়ে যায়’। বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকার ইউটিউবে দেখে ও শুনে অসংখ্য মানুষ রাষ্ট্রপতির প্রতি মুগ্ধ হয়ে নানা মন্তব্য করেছেন। আবু ইউসুফ নামে একজন মন্তব্যকারী কবিতা লিখে ফেলেছেন। তিনি রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “সবাই আপনাকে ভালোবাসে আপনি মানুষ ভালো, আপনার মতো সবাই হলে দেশটা হতো আলো। সবাই মিলে দেশের তরে দেবো ভালোবাসা, একই দেশের মানুষ মোরা; তবু দ্বেষে ঠাসা!”

জাহিদুল ইসলাম নামে একজন ব্যক্তি কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য শুনে ইউটিউবে লিখেছেন, ‘সেই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যিনি নিজের সমালোচনা করতে জানেন, আর তিনি হলেন আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রপতি মহোদয়, এ্যাড. আ. হামিদ’। শাকিল শেখ নামে একজন লিখেছেন, ‘তিনি যেমন ভাবেন তেমনি বক্তব্য দেন…তাই তার বক্তব্য খুব ভাল লাগে…আর আমার একজন প্রিয় বক্তা তিনি’।

ইচ্ছে করলেই সমাবর্তনের মত একটি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ বাংলায় কথা বলতে পারবেন আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রপতি। তবে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয়, শুদ্ধ বাংলায় সব কথা বললে হয়ত রাষ্ট্রপতির ভাষণ হয়ত এভাবে জনসমাদৃত হবে না।

শেখ আদনান ফাহাদ, লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!