• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়


নিজস্ব প্রতিবেদক জুলাই ৮, ২০২০, ০২:০১ পিএম
রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

ঢাকা: রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। করোনাভাইরাস টেস্ট না করেই মনগড়া রিপোর্ট প্রদান, ভুতুড়ে বিল দিয়ে অর্থ আদায়, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চিকিৎসা দেয়া, সরকার থেকে বিনা মূল্যে পরীক্ষা করে রোগীদের থেকে পরীক্ষা বাবদ অর্থ নেয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে।

এ কারণে সোমবার বিকালে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডের হাসপাতালটি ও এর মিরপুর শাখায় অভিযান চালায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। মঙ্গলবার উত্তরা শাখা ও অফিস সিলগালা করা হয়। এদিন স্বাস্থ্য অধিদফতর গোটা হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরি করে অপকর্মগুলো করে যাচ্ছিলেন।

করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে তার বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়টি সামনে এলেও এর আগে থেকেই হাসপাতালটির বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ছিল। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত অনেককে ৬ মাস থেকে ১ বছরের বেতন পরিশোধ না করে চাকরি থেকে বিদায় করেছেন। মিরপুর পল্লবীর ১৪ নম্বর রোডের ১১ নম্বর ছয় তলা বাড়িটির ৫ তলা তিনি হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। ২০১৬ সালের ৮ মে এর ভাড়া বাবদ মাসে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়ার চুক্তি হয়।

কিন্তু তিনি তা নিয়মিত পরিশোধ করেননি। আয়ের উৎস একমাত্র বাড়ি থেকে ভাড়া বাবদ অর্ধকোটি টাকা বাকি থাকায় ভবন মালিক ফিরোজ আলম এ নিয়ে দুই দফায় পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন। ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর করা ওই দুটি জিডিতে মালিক ফিরোজ আলম উল্লেখ করেন, ভাড়া চাইলে হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ বড় ধরনের ক্ষতি করার ভয়ভীতি দেখান।

ফিরোজ আলম বলেন, ‘ভবনটা ভাড়া দিয়ে আমি বিপদে পড়ে গেছি। ভবনটিই আমার আয়ের একমাত্র উৎস। অথচ তিনি (সাহেদ) ঠিকভাবে ভাড়া দেন না। আবার ভাড়া চাইলে হুমকিও দেন। কয়েকবার ভাড়া বাবদ চেক দিলেও তা ব্যাংকে ডিজঅনার হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে জানুয়ারি মাসের তারিখে তিনি ১০ লাখ টাকার চেক দেন। প্রিমিয়ার ব্যাংকের সেই চেকও ডিজঅনার হয়। এসব ঘটনায় আমি দু’দফা জিডি করেছি। এ ছাড়া চলতি বছরের মার্চে তাকে লিগ্যাল নোটিশও দেয়া হয়েছে।’

এদিকে সরেজমিন দেখা যায়, মিরপুরে হাসপাতালের প্রবেশপথে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের সাবেক আইজি ও র‌্যাবের মহাপরিচালকের সঙ্গে রিজেন্ট মালিক সাহেদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ঝুলছে। এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে রিজেন্ট মালিকের অনেক ঘনিষ্ঠ ছবি ভাসছে। এর মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের একাধিক মন্ত্রীও রয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই রিজেন্ট মালিক সাহেদ বিভিন্ন অপকর্ম করছেন। এ বিষয়ে কেউ কিছু বললে দেখে নেয়ার হুমকি দেন মালিক।

অনুসন্ধানে হাসপাতালটিতে ভুতুড়ে বিল নেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২১ জুন করোনায় আক্রান্ত ৫৭ বছর বয়সী মা সেলিনা বেগমকে মিরপুর শাখায় ভর্তি করেন গণমাধ্যমকর্মী মো. আলী আশরাফ উদ্দিন। চিকিৎসা বাবদ শুরুতে তার বিল করা হয় ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৯০০ টাকা।

পরে কলম দিয়ে কেটে তা করা হয় ৩ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ টাকা। এরপর ওই গণমাধ্যমকর্মী নিজের পরিচয় দিলে টাকা আরও কমানো হয়। তিনি বলেন, বেশিরভাগই ছিল ভুতুড়ে বিল। অসংখ্য খাত বের করে তারা বিল করেছিল। এ ছাড়া চিকিৎসায় অনিয়ম ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার অভিযোগও রয়েছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে।

হাসপাতালটিতে অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্ব দেন র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। তিনি বলেন, আমরা যতটুকু প্রমাণ পেয়েছি-মোট ১০ হাজার জনের নমুনা তারা সংগ্রহ করেছে। সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে। এর মধ্যে তারা আইইডিসিআর, আইটিএইচ ও নিপসম থেকে ৪ হাজার ২০০ রোগীর বিনা মূল্যে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে এনেছে। তার মানে বাকি প্রায় ছয় হাজার নমুনা যেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে সেগুলোর কোনো টেস্ট করা হয়নি।

স্যাম্পলগুলো এনে ফেলে দেয়া হয়েছে। কম্পিউটারে রিপোর্ট প্রিন্ট করে মনগড়া পজিটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী টেস্ট বাবদ কোনো টাকা না নেয়ার কথা থাকলেও তারা প্রতিটি টেস্ট বাবদ সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে নিয়েছে।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, এখানে যে ৪ হাজার ২০০ রোগীর তালিকা আমরা পেয়েছি তাতে দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালটি তাদের কাছ থেকে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর বাইরেই প্রায় তিন গুণ রোগীর স্যাম্পল কালেক্ট করা হয়েছে। যেগুলোর কোনো টেস্টই হয়নি।

সব মিলিয়ে তিন কোটির বেশি টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া ভর্তি রোগীদের থেকে অবস্থা বুঝে ২ লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার ভুতুড়ে বিলের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি আরও বলেন, অভিযানে একটি রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। যেখানে অবৈধভাবে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদফরের স্টিকার লাগানো ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দেয়ার জন্যই এই অপকৌশল করা হয়েছে।

সারোয়ার আলম বলেন, ২০১৪ সালে তাদের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর অনুমোদন ছাড়াই হাসপাতালটি চলছিল। তারা হাসপাতাল ভবনের ভাড়াও ঠিকভাবে পরিশোধ করেনি। এখানে কর্মরত অনেককে ছয় মাস ধরেও বেতন দেয়া হয়নি।

রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে তা হাসপাতালে টানিয়ে প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা করে সে। এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগে হাসপাতালটির উত্তরা শাখা ও অফিস সিলগালা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে র‌্যাব বাদী হয়ে নিয়মিত মামলা করবে। আমরা অপকর্মে জড়িত মূল হোতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।

র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, আমরা হাসপাতালটির মিরপুর ও উত্তরা শাখায় অভিযান চালিয়েছি। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে একটি ভবনের দোতলা ও তৃতীয় তলায় তাদের অফিস। আমরা সেখান থেকে অনেক ডকুমেন্ট উদ্ধার করেছি। তাদের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ। টেস্ট না করেই করোনা রোগীদের পজিটিভ ও নেগেটিভ রেজাল্ট দেয়া হতো।

হাসপাতাল বন্ধের নির্দেশ স্বাস্থ্য অধিদফতরের : এদিকে রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের উত্তরা ও মিরপুর শাখার কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। মঙ্গলবার অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. মো. আমিনুল হাসান এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেন। ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ রেগুলেশন অর্ডিনেন্স’ অনুযায়ী বিভিন্ন অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে এ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/টিআই

Wordbridge School
Link copied!