রিফাত হত্যার মাস্টার মাইন্ড স্ত্রী মিন্নি

ঢাকা : বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে ৬ জনের মৃত্যু দণ্ড দিয়েছেন আদালত। এসময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা সবাই আদালতে উপস্থিত ছিল। 

বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুর পৌনে ২টার দিকে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। এদিক চাঞ্চল্যকার এই মামলায় রায় ঘোষণার পর আদালতে কান্নায় ভেঙে পড়েন আসামিরা। 

আরো পড়ুন: মিন্নিসহ ৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড

রায় ঘোষণার সময় বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, এটি একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এই ঘটনায় আগামীতে কেউ যেন এমন লোমহর্ষক ঘটনা ঘটাবার সাহস না পায় সেই জন্যই তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩৪ ও ৩০২ ধারায় সরাসরি হত্যার অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হলো। 

দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি রায়ের জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর দিন ঠিক করে দেন। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ভূবন চন্দ্র হালদার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে, রিফাত হত্যার মুল মাস্টার মাইন্ড ছিলেন মিন্নি বলে মনে করছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ভূবন চন্দ্র হালদার রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বলেন, রিফাত হত্যার মুল মাস্টার মাইন্ড ছিলেন মিন্নি। 

রিফাত হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এবং এই হত্যার মাস্টার মাইন্ড ছিলো মিন্নি এমনটাই বললেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মুজিবুল হক কিসলু।

তিনি আরও বলেন এ মামলায় আদালত পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে যে মিন্নি ছাড়া এই হত্যাকাণ্ড ঘটতো না। এবং মিন্নি নয়ন বন্ডসহ অন্যান্য আসামিদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। হত্যার একমাত্র পরিকল্পনা ছিল মিন্নির। মিন্নির কারণেই তার পরিকল্পনায় অন্যরা যুক্ত হয়েছে। মিন্নি ষড়যন্ত্র না করলে এই অপরাধীরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত হত না।

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯) ও আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)।

এছাড়া এ মামলায় চার আসামিকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়েছে। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)।

১৫ মাস আগের ওই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ১০ জনের বিচার চলে জজ আদালতে। বাকি ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় বরগুনার শিশু আদালতে আলাদাভাবে তাদের বিচার চলছে।

গত বছরের ২ জুলাই রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড (২৫) পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী মিন্নিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুভাগে বিভক্ত অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয় পুলিশ। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। এর পর ৭৬ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ নির্ধারণ হয়।

প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে জামিনে আছেন নিহত রিফাতের স্ত্রী ও মামলার সাত নম্বর আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। আর ৬ নম্বর আসামি মো. মুসা পলাতক। অবশিষ্ট ৮ আসামি বর্তমানে বরগুনা জেলা কারাগারে। তারা রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে শত শত লোকের উপস্থিতিতে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, ধারালো দা দিয়ে রিফাতকে একের পর এক কোপ দিতে থাকেন দুই যুবক। ওই সময় রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি ওই দুই যুবককে প্রতিহত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রিফাতকে বাঁচানো যায়নি। গুরুতর আহত অবস্থায় বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান রিফাত।

এ ঘটনায় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হয়। এর পর আরেকটি ভিডিও ভাইরাল হলে মামলার প্রধান সাক্ষী মিন্নিকে গত বছরের ১৬ জুলাই রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। দুদিন পর মিন্নিকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। তখন ১৬৪ ধারায় মিন্নির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদালতে রেকর্ড করা হয়। পরদিন বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। এ হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

অবশ্য মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন শুরু থেকেই অভিযোগ করেন, নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর নেপথ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের মদদ রয়েছে।

গত ৩০ জুলাই বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান মিন্নির জামিন নামঞ্জুর করেন। তার আগে ২১ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালত মিন্নির জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। গত বছরের ২৯ আগস্ট শর্তসাপেক্ষে মিন্নির জামিন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট। সেই থেকে জামিনে আছেন রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া মিন্নি।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ