• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
কিশোরী মায়ের মৃত্যু সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে

রুখতে হবে অনিরাপদ কিশোরী মাতৃত্ব


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ১২, ২০১৯, ০৪:১৮ পিএম
রুখতে হবে অনিরাপদ কিশোরী মাতৃত্ব

ঢাকা : ‘পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহণ করি, কৈশোরকালীন মাতৃত্ব রোধ করি’- এ স্লোগানকে সামনে রেখে ৭ থেকে ১২ ডিসেম্বর পরিবার কল্যাণ সেবা ও প্রচার সপ্তাহ পালিত হয়েছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ‘মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য’বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের তুলনায় গ্রামে কিশোরী মা হওয়ার প্রবণতা বেশি। এখনো ৮৫ শতাংশ মায়েরই বাড়িতে ঝুঁকির মধ্যে প্রসব করানো হচ্ছে। মাত্র ১৫ শতাংশ মা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসব করানোর সুযোগ পান। ইউনিসেফের তথ্যমতে, ১৫  থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মা হওয়ার মৃত্যুঝুঁকি ২০ বছরের বেশি বয়সি নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ।

অন্যদিকে ১৫ বছরের কম বয়সি মায়েদের প্রসবজনিত মৃত্যুঝুঁকি পাঁচগুণ  বেশি। এছাড়া বাল্যবিয়ে ও গর্ভধারণে মা ও নবজাতকের অসুস্থতা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এরকম গর্ভধারণের কারণেই অনেক ক্ষেত্রেই কম ওজনের শিশুর জন্ম হয় আর ওই শিশুর জীবনে পুষ্টিহীনতার চক্র শুরু হয়।

অপরদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, অপুষ্টিজনিত মাতৃমৃত্যুর ২০ ভাগ ঘটছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও রক্তস্বল্পতার প্রভাবে। এর প্রধান কারণ কিশোরী মাতৃত্ব। এক তথ্য উপাত্ত থেকে জানা গেছে, দেশে কৈশোরকালীন মাতৃত্বের বর্তমান হার প্রতি লাখে ১১৩ জন, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পঞ্চাশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন কিশোরী মা কখনোই সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারে না। তাই মাতৃমৃত্যুর এই হার কমিয়ে আনতে হলে প্রথমেই বাল্যবিয়ে কমাতে হবে। পাশাপাশি কিশোরী মায়েদের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে হলে তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে।

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফের মতে, ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের গর্ভাবস্থা বা সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুঝুঁকি ২০ বছরের বেশি বয়সি নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ। আর ১৫ বছরের কম বয়সি মায়েদের গর্ভাবস্থা বা শিশু জন্মদানের সময় মৃত্যুঝুঁকি পাঁচগুণ বেশি।

এছাড়া বাল্যবিবাহ ও গর্ভধারণ মা ও নবজাতক উভয়ের অসুস্থতা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এরকম গর্ভধারণের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কম ওজনের শিশুর জন্ম হয়, যেখান থেকে ওই শিশুর জীবনে পুষ্টিহীনতার চক্র শুরু হয়।

দেশে গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি, স্বাস্থ্যসচেতনতা এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা গ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। আর সরকারের বহুমাত্রিক স্বাস্থ্যসেবা তৎপরতার ফলে মাতৃমৃত্যুর হার অনেকটাই কমে এসেছে। দেখা গেছে, গত দেড় দশকে মাতৃমৃত্যুর হার ৪৫ শতাংশ কমেছে।

তবে কিশোরী মায়ের মৃত্যুহার এখনো অনেক বেশিই রয়ে গেছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের যেসব দেশে কিশোরীদের মধ্যে গর্ভধারণের হার বেশি, বাংলাদেশ তার অন্যতম।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪৩ শতাংশ কিশোরী মা-ই গর্ভজনিত সমস্যার কারণে মৃত্যুবরণ করে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পনেরো  থকে উনিশ বছরের বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার অপূরণীয় চাহিদার হার শতকরা ১৭ ভাগ।

তাই পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে সকল দম্পতিকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি বিবাহিত কিশোরীদের সঠিক পদ্ধতির ব্যবহার ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবার বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ‘মা ও শিশুস্বাস্থ্য এবং কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য’বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রতি লাখ জীবিতসন্তান জন্মে মারা যাচ্ছেন ১৭২ জন মা, যাদের মধ্যে কিশোরী মায়ের সংখ্যাই বেশি।

অথচ টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ৭০ বা তার নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু দেশে এখনো ১৫ বছর বা এর কম বয়সি মায়ের সংখ্যা বাড়ছেই। যাদের মাতৃত্বকালীন ঝুঁকি অনেক বেশি।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ৪৩ শতাংশ কিশোরী মা গর্ভজনিত ও প্রসবসংক্রান্ত জটিলতার কারণে মারা যাচ্ছে। অপরদিকে দেড় দশকে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার ৬০ শতাংশ কমলেও কিশোরী মাতৃমৃত্যুর হার কিছুতেই কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না অল্প বয়সে বিয়ে ও সন্তান ধারণ। কিশোরী মাতৃমৃত্যুর হার জাতীয় মাতৃমৃত্যু গড়ের প্রায় দ্বিগুণ।

শিশুমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ বেশি। প্রতি বছর ২৩ হাজার মায়ের মৃত্যু হচ্ছে সন্তান জন্মের সময়। প্রসবজনিত জটিলতায় বছরে মারা যাচ্ছে ৬ লাখ মা। ১৮ বছর বয়সের আগেই ৬৬ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়। কিশোরী অবস্থাতেই গর্ভধারণ করেন তাদের ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রতি হাজার শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ২ দশমিক ৯ ভাগ মা মারা যান। তাদের মধ্যে কিশোরী মায়ের সংখ্যাই বেশি।

এ বয়সের জন্য যথাযথ যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য ও সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ অপর্যাপ্ত।  বিশিষ্ট গাইনোকোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. লায়লা আরজুমান বানু এক বিবৃতিতে বলেছেন, চিকিৎসাসেবা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সমাজ ও পরিবার যথাযথ দায়িত্ব পালন না করায় মাতৃস্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান ধারণ, গর্ভপূর্ব ও গর্ভকালীন এবং গর্ভ-পরবর্তী জরুরি প্রসূতি চিকিৎসার অভাবেও এ মাতৃমৃত্যু ঘটছে। তাই এ মাতৃমৃত্যু রোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। পাশাপাশি বাল্যবিয়ে ও অল্প বয়সে সন্তানধারণ বন্ধ করতে হবে।

দেশে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ নির্ধারিত হলেও গর্ভধারণের জন্য এ বয়সটাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন চিকিৎসকরা। তাদের মতে, ২২-২৫ বছর বয়সই গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত সময়।

এর আগে গর্ভধারণ করলে মা নানা ধরনের গর্ভজনিত সমস্যায় ভোগে এবং এতে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি থাকে। ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে দেশে প্রায় ৫২ শতাংশ কিশোরী রক্তশূন্যতায় ভুগছে।

‘অ্যান আউটলাইন অব অ্যানিমিয়া অ্যামাং অ্যাডোলোসেন্ট গার্লস ইন বাংলাদেশ : ফাইন্ডিংস ফ্রম আ ক্রস-সেকশনাল স্টাডি’ শীর্ষক ওই গবেষণায় ১১ হাজার ৪২৮টি পরিবারের ১ হাজার ৩১৪ জন কিশোরীর ওপর জরিপ করা হয়।

এতে দেখা যায়, ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোরী কমবেশি অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ স্বল্পমাত্রায়, ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মাঝারি মাত্রায় ও দশমিক ২ শতাংশ কিশোরী মারাত্মক মাত্রায় রক্তশূন্যতায় ভুগছে। ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের মধ্যে রক্তশূন্যতার প্রাদুর্ভাব নিরূপণে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

কিশোরী মাতৃত্ব রোধে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ : পিতা-মাতার উচিত কিশোরীকে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে না দেওয়া। স্বামীর উচিত স্ত্রীকে ২০ বছর বয়সের আগে সন্তান গ্রহণে উৎসাহিত অথবা বাধ্য না করা।

উপযুক্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা। স্ত্রী গর্ভবতী হলে তাকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ডেলিভারির সময়ে ট্রেনিংপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সাহায্য নেওয়া। পরিবারের সব সদস্যের দায়িত্ব হলো গর্ভবতীকে সহানুভূতির সঙ্গে পরিচর্যা করা।

গর্ভকালীন সময়ে মেয়েটিকে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে এক কাপ ঘন ডাল, এক মুঠি বেশি শাক-সবজি ও একটি ফল, ছোট মাছ, এক মুঠি বাদাম, সম্ভব হলে একটি ডিম আর এক গ্লাস দুধ খাওয়ানো। প্রতিদিন দিনের বেলা অন্তত দু’ঘণ্টা তাকে বিশ্রাম দেওয়া। মানসিক দিক থেকে নির্ভার রাখা।

কিশোরী গর্ভবতী হলে তার মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায় : এসডিজির সূচকে কৈশোরকালীন মাতৃত্ব কমানোর বিষয়ে গুরত্বারোপ করা হয়েছে, যা আমাদের দেশের জন্য এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছরগুলোতে দেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

নারী শিক্ষা, সফল টিকাদান কর্মসূচি এবং পরিবার পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্যই এই সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই সফলতার পরও আমাদের অনেক অর্জন ম্লান হয়ে যায়, যখন একটি মেয়ে কিশোরী বয়সে মা হতে গিয়ে অকালে প্রাণ হারায়।

পনেরো থেকে উনিশ বছরের বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার অপূরণীয় চাহিদার হার শতকরা ১৭ ভাগ। তাই পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে সকল দম্পতিকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি বিবাহিত কিশোরীদের সঠিক পদ্ধতির ব্যবহার ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবার বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

 স্বর্ণ-কিশোরীরাই গড়বে সোনার বাংলাদেশ : স্বর্ণ-কিশোরীর প্রধান কাজ নিরাপদ মাতৃত্ব ও কিশোরী বয়ঃসন্ধি স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিজেকে সচেতন ও সক্ষম করা এবং অন্যদের এ বিষয়ে অনুরূপভাবে আলোকিত হতে সহায়তা করা।

আমরা যদি সেই মেয়েটির কিশোরী বয়সে যখন তার প্রথম মাসিক হয়, সেই সময়টাকে তাকে স্বাস্থ্য নিয়ে, তার জীবন নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে সচেতন করতে পারি তাহলে আমরা একজন শ্রেষ্ঠ মা পেতে পারি। আর শ্রেষ্ঠ মা মানেই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সন্তান। একজন মা যদি নিজের শরীর সুস্থ রাখে, তবেই সে সঠিক ওজনের বাচ্চা জন্ম দেবে।

আর যে শিশুটিকে আমরা তার পেটের মধ্যে দিয়ে দিচ্ছি, তার নিজের শরীর তখনো সন্তান ধারণের জন্য প্রস্তুত হয়নি, কিন্তু প্রক্রিয়ার মধ্যে সন্তানও ধারণ করে ফেলেছে। ফলে কিশোরী মা এবং তার সন্তান দুজনের জীবনই হয়ে পড়ছে ঝুঁকিপূর্ণ। একটি শিশুর গর্ভে আরেকটি শিশুর জন্ম কীভাবে নিরাপদ হতে পারে?

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!