• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রুপালি ইলিশের সোনালি দিন


নিতাই চন্দ্র রায় এপ্রিল ৪, ২০১৯, ০১:২০ পিএম
রুপালি ইলিশের সোনালি দিন

ঢাকা : ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা, বোয়াল মাছের দাড়ি, টিক্কা খানে ভিক্ষা করে শেখ মুজিবের বাড়ি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ময়মনসিংহ অঞ্চলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে খেলার ছলে এই শোলকটি উচ্চারণ করত। আমরা গভীর মনোযোগসহকারে বালক-বালিকাদের সেই সাহসী উচ্চারণ শুনতাম। আমাদের মানসপটে ভেসে উঠত বাঙালির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের উত্তোলিত হাত এবং হূদয়ের গভীরে বার বার প্রতিধ্বনিত হতো তার পৃথিবী কাঁপানো ভাষণ।

তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এ শোলকের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতির যেমন বিশালত্ব প্রকাশ করা হয়েছে, তেমনি নরঘাতক টিক্কা খানের প্রতি জানানো হয়েছে চরম ধিক্কার ও তীব্র ঘৃণা। অন্যদিকে বাঙালির ঐতিহ্য ইলিশ মাছের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরি করা হয়েছে। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। আমাদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালির নববর্ষে পান্তা-ইলিশ, জামাই ষষ্ঠিতে আম, জাম ও কাঁঠালের সঙ্গে সর্ষে ইলিশ এবং বিজয়া দশমির দিনেও বাঙালি হিন্দুর চাই সুস্বাদু ইলিশ।

আমাদের অর্থনীতিতেও ইলিশের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ এবং দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১২ শতাংশ। ২০১৬ সালে ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই ইলিশের স্বত্ব এখন বাংলাদেশের। ইলিশ আহরণে উপকূলীয় প্রায় পাঁচ লাখ মৎস্যজীবীসহ পরিবহন, বিক্রি, জাল ও নৌকা তৈরি, বরফ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং রফতানি ইত্যাদি কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশের ২৫ লাখ লোক জড়িত।

ইলিশ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ একক মৎস্য প্রজাতি, যা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইলিশের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুমে অর্থাৎ আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগের ৪ দিন, পূর্ণিমার দিন এবং পূর্ণিমার পরের ১৭ দিন অর্থাৎ মোট ২২ দিনের জন্য ইলিশ আহরণ, সংরক্ষণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৭৮ ভাগ। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির এ ধারা ধরে রাখাই বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য ইলিশের মজুত নিরূপণ ও সর্বোচ্চ সহনশীল আহরণ মাত্রা নিয়ে বিজ্ঞানীদের আরো নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে।

ইলিশ বিষয়ে নিবিড় গবেষণা অব্যাহত রাখার জন্য ২০১৬-১৭ আর্থিক বছর থেকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আওতায় ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ শীর্ষক একটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে। ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ইলিশসম্পদ উন্নয়নে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবেন- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু মাছ ইলিশের টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধি নির্ভর করে এর প্রজনন সফলতা, জাটকা রক্ষা এবং মাছ আহরণের পরিমাণের ওপর। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির মূলে রয়েছে জাটকা সুরক্ষা।

ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে সরকার বিভিন্ন নদ-নদীর জাটকাপ্রধান অঞ্চলে ৬টি ইলিশ অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। একেকটি অভয়াশ্রম ইলিশ উৎপাদনের সূতিকাগার হিসেবে কাজ করছে। মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অুনযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খসরু বলেছেন, এ বিস্ময়কর অর্জন সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনার কারণে। তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। তার সাহসী ও সঠিক উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশ আজ খাদ্য ও শাকসবজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় এবং ইলিশ উৎপাদনে প্রথম। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯৮৬-৮৭ সালে দেশে ইলিশ উৎপাদন হতো ১ লাখ ৯৫ হাজার টন। ২০১১-১২ সালে সেই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪০ হাজার টন। ইলিশ আছে এমন ১১টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশের ইলিশ উৎপাদন কমেছে। একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের কথা, যে হারে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে তাতে ২০২২ সালে বিশ্বের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হবে বাংলাদেশে।

ইলিশ মাছ যেমন সুস্বাদু, পুষ্টিগুণেও তেমনি ভরপুর। ইলিশ মাছের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মানুষের দেহের রক্তের কোলেস্টেরল ও ইনসুলিনের মাত্রা কমায়। ফলে হূদযন্ত্র সুস্থ থাকে। ইলিশ মাছ খেলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়। ইলিশ মাছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ছাড়াও ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক, ক্রোমিয়াম ও সেলেনিয়ামের মতো খনিজ পদার্থ রয়েছে। জিংক ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপকারী।

বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাসহ উপমহাদেশের ২৬ কোটি লোক ইলিশের স্বাদ উপভোগ করে। বাংলাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। মোট আহরিত ইলিশের শতকরা ৬০ ভাগ ধরা পড়ে বাংলাদেশে। মিয়ানমারে ধরা পড়ে ২০ শতাংশ, ভারতে ধরা পড়ে ১৫ শতাংশ এবং বাকি ৫ শতাংশ ইলিশ ধরা পড়ে অন্যান্য দেশে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী গত বছর ২২ দিন মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করার ফলে ৭ লাখ ৬০ হাজার কেজি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। এতে ৫০ ভাগ ডিমের সফল পরস্ফুিটন হলে এবং ১০ ভাগ বেঁচে থাকলে ৩৫ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বলে গবেষকরা মনে করেন। এ কারণে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের এবারের স্লোগান ‘কোনো জাল ফেলব না, জাটকা ইলিশ ধরব না’ সঠিক ও বাস্তবসম্মত।

বাংলাদেশে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অন্য এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২০টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখানদী মহানন্দা, তিস্তা ও মৌলভী বাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোদির হাওরে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মৎস্য অধিদফতর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় দেশব্যাপী ইলিশের উৎপাদন ও বিস্তৃতি বেড়েছে। গত এক বছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ২১ হাজার টন। বর্তমান মৎস্যবান্ধব সরকারের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক মৎস্য অধিদফতরের মাধ্যমে ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সরকারের নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের কারণে ইলিশ উৎপাদনে এ সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এসব কর্মসূচির আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জাটকাসমৃদ্ধ ১৭ জেলার ৮৫টি উপজেলায় জাটকা আহরণে বিরত ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭৪টি জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হিসেবে ৪ মাসের জন্য মোট ৩৯ হাজার ৭৮৮ টন চাল প্রদান করা হয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকালীন ছাড়াও গত দুই অর্থবছরে মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন ২২ দিনের জন্য পরিবারপ্রতি ২০ কেজি হারে মোট ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬২টি পরিবারকে ১৪ হাজার ৮২৪ টন ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রকৃত মৎস্যজীবী ও জেলেদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতকল্পে মৎস্য অধিদফতর থেকে ইতোমধ্যে ১৬ লাখ ২০ হাজার মৎস্যজীবী ও জেলেদের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে এবং ১৪ লাখ ২০ হাজার জেলের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে পরিচয়পত্র।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদ-নদী ও সাগর থেকে ইলিশ আহরণকারী জেলেরা অত্যন্ত গরিব মানুষ। মাছ ধরাই তাদের একমাত্র পেশা। ১২ মাসের বছরের মধ্যে যদি ৮ মাস ২২ দিনই ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে তাদের সংসার চলে কীভাবে? মাসে সরকারি সাহায্যের ৪০ কেজি চালে তাদের ভাতের ব্যবস্থা হলেও তেল, ডাল, লবণ ও তরিতরকারি কেনার পয়সা আসবে কোথা থেকে? কোথা থেকে আসবে পরিবার-পরিজনের চিকিৎসার খরচ? এ বিষয়গুলোও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। শুধু কারেন্ট জাল ধ্বংস, জাটকা আটক ও জেলেদের জেল জরিমানা করেই এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এজন্য জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগি পালন, মাশরুম চাষ, গরু-ছাগল পালন, ভ্যান-রিকশা চালানো, সেলাই শিক্ষা, খাঁচায় মাছ চাষ, বসতবাড়ির আশপাশে সবজি ও ফলমূলের চাষ প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। জাটকা ও মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকালীন জেলেদের সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাদের দাদন ব্যবসায়ী মহাজনের কাছে পানির দামে ইলিশ বিক্রি করে অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করতে না হয়। তাহলেই জাটকা নিধন হ্রাস পাবে। ইলিশের উৎপাদন বাড়বে।

লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড, গোপালপুর, নাটোর

Wordbridge School
Link copied!