• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
সরকার নির্ধারিত দরে মিলছে না কিছুই

রোজা আসতেই বাজারে আগুন


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ১৯, ২০১৮, ০৫:১৩ পিএম
রোজা আসতেই বাজারে আগুন

ঢাকা : বাজারে এখন চলছে নৈরাজ্য। রাজধানীসহ সারা দেশে একই চিত্র। ইচ্ছামতো পণ্যের দাম হাঁকছেন দোকানিরা। হঠাৎ দর বৃদ্ধির পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে পারছেন না তারা। প্রতিবাদ করলেই চিরাচরিত সেই মুখস্থ দোহাই- সরবরাহ কম, বৃষ্টি ইত্যাদি। অথচ এক মাস আগেই সরকারের ঘোষণা ছিল এবার রোজায় সব পণ্যের মজুত চাহিদার তিন গুণ, চার গুণ পর্যন্ত। তাহলে দাম বাড়ছে কেন?

অসহায় ক্রেতারা বলছেন, বাড়তি মুনাফার লোভ। ব্যবসায়ীরা ওঁৎ পেতে থাকেন রোজার জন্য। এ সময় তারা ইচ্ছামতো ক্রেতার পকেট কাটেন। আর সরকার নীরব দর্শক হয়ে তা দেখে।  

শুক্রবার (১৮ মে) ছিল রমজানের প্রথম দিন, তার ওপর আবার শুক্রবার। ফলে বাজারে ছিল উপচেপড়া ভিড়। এতে বিক্রেতারা বেজাই খুশি। হুমড়ি খেয়ে পড়া ক্রেতাদের পকেট কেটেছেন তারা মহানন্দে। এ যেন বেশি দাম আদায়ের বিশাল প্রতিযোগিতা। রমজানে বাড়তি চাহিদা তৈরি হওয়ায় অধিকাংশ পণ্যেরই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছামতো। বাদ যায়নি ইফতারসামগ্রীও। কোনো ব্যবসায়ীই মানছেন না সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম।  

এমনিতেই রোজা আসছে এই দোহাই দিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

শুক্রবার (১৮ মে) নতুন করে আরো বেড়েছে সবজি, মাছ ও দেশি মুরগির দাম। একই সঙ্গে ইফতারির নানা সামগ্রী, মুড়ি, চিড়া, গুড়ের দামও আগুন। আগে থেকেই চড়ে রয়েছে চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, ব্রয়লার মুরগি, ছোলাসহ অন্যান্য পণ্যের দর।  

শুক্রবার রাজধানীর কোনো বাজারেই ৬০ টাকার নিচে সবজি মেলেনি। বেগুনে গুনতে হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা, যা এক দিন আগেও ২০ টাকা কম ছিল। প্রতিকেজি শসা ৬০-৭০ টাকা, ধনেপাতা ১২০ টাকা ও এক হালি লেবু ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দুই-তিন দিন আগেও অর্ধেক দামে পাওয়া যেত।  

মোকামে দাম অর্ধেক : রাজধানীর বাজারগুলোতে সবজির একটি বড় অংশ আসে উত্তরবঙ্গ থেকে। জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের হাট থেকে প্রতিদিন ট্রাকে রাজধানীতে সবজি পাঠান আয়োরুল হক বাবু। বৃহস্পতিবার যে দরে তিনি সবজি পাঠিয়েছেন সেই দরেই কারওয়ান বাজারে রাতে কেনাবেচা হয়েছে। তবে শুক্রবার রাজধানীর অন্যান্য বাজারে সেসব পণ্যই কেনাবেচা হয়েছে দ্বিগুণ দামে।  

ওই দিন বেগুনের দাম কত ছিল জানতে চাইলে বাবু জানান, বৃহস্পতিবার বিকালে ভালোমানের গোল বেগুন ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। লম্বা লরি আর হাজারি (স্থানীয় জাত) বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজির পাইকারি দাম ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা। এই বেগুনই কারওয়ান বাজারে শুক্রবার ভোরে মানভেদে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে বলে জানান ওই বাজারের আড়তদার রতন মিয়া। অথচ খুচরা বিক্রেতারা দ্বিগুণ দাম (৮০-১০০ টাকা কেজি) আদায় করেছেন।

কোনো পণ্যের মজুতে ঘাটতি নেই : চিনি ও খুচরা তেলের দাম বেড়েছে রমজানের দুই সপ্তাহ আগেই। গত রোববার (১৩ মে) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ, বিপণন ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তাতেও বলা হয় কোনো পণ্যের মজুতে সঙ্কট নেই। আর বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে কেউ যাতে অস্বাভাবিকভাবে মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সে লক্ষ্যে বাজারে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি চলছে। কিন্তু কোথায় কী? দাম বৃদ্ধি তো ঠেকানো যায়নি।  

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশে ১৫ লাখ টন ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে রমজান মাসে লাগে আড়াই লাখ টন। চলতি বছর দেশে প্রায় ৭ লাখ টন সরিষা উৎপাদন হয়েছে। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ১৮ লাখ ৮৩ টন ভোজ্য তেল আমদানি হয়েছে। সুতরাং এই মুহূর্তে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি ভোজ্য তেল মজুত রয়েছে। একইভাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ২০ লাখ ৪৩ হাজার টন চিনি আমদানি হয়েছে। কিন্তু রমজানে প্রয়োজন হয় মাত্র তিন লাখ টন।

এ ছাড়া রোজায় ৩ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদার বিপরীতে নয় মাসে ৫ লাখ ১৬ হাজার টন আমদানি হয়েছে। এবার দেশেও উৎপাদিত হয়েছে ভালো পরিমাণ পেঁয়াজ। ৬০ টন ডালের চাহিদার বিপরীতে এসেছে ৮ লাখ ৯৭ হাজার টন এবং ৮০ হাজার টন ছোলার ঘাটতি পূরণে এসেছে ২ লাখ ৩৩ হাজার টন। সুতরাং এই মুহূর্তে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পণ্য মজুত আছে। তবুও দাম বাড়ছে।

করপোরেশন নির্ধারিত দামে মাংস মিলছে না কোথাও : রমজান উপলক্ষে রাজধানীতে মাংসের দাম বেঁধে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। সে হিসেবে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম সর্বোচ্চ ৪৫০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু এ দামে কোথাও মাংস বিক্রি হচ্ছে না। বাজারে গতকাল প্রতিকেজি মাংসের দাম ছিল ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত।  

বাজারগুলোতে গতকাল নির্ধারিত দামের তালিকা পাঠানো হলেও সেটা টাঙানো ছিল না অধিকাংশ দোকানে। ব্যবসায়ীরা এখন বলছেন, করপোরেশন নির্ধারিত দামে বিক্রি করলে তাদের লোকসান গুনতে হবে। জানতে চাইলে খিলগাঁও বাজারে মাংস বিক্রেতা জমির শেখ বলেন, সরকার তো আমাদের গরু কিনে দেয়নি। এই দাম মানা সম্ভব নয়।

তালতলা বাজারে বিক্রেতা ফালান মিয়া বলেন, ৪৫০ টাকায় মাংস বিক্রি করলে প্রতি গরুতে ৭ হাজার টাকা লোকসান হবে। ওই টাকা কি সরকার দেবে?
বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, দেশি গরুর পাশাপাশি ভারতীয় গরুর মাংসের কেজি ৪২০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও সব মাংসই বিক্রি হচ্ছে দেশি বলে। একই অবস্থা খাসির মাংসের ক্ষেত্রেও। কারণ বাজারে ছাগলের মাংস ৬০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও তা বিক্রি হচ্ছে খাসির দামে। প্রতি কেজি ৭৫০ টাকা।

প্রথম দিনে মাছের দাম বেড়েছে : দুই দিন আগেও খিলগাঁও রেলগেটে প্রতি কেজি বড় সাইজের রুই, কাতলা বা মৃগেল ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। গতকাল সেটাই বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা। এর যুক্তি হিসেবে কেউ দায়ী করেছেন রমজানের বাড়তি চাহিদাকে, কেউ আবার বলছেন, বর্ষার কারণে আমদানি কম। কারণ যাই হোক শেষ দুই দিনে পাইকারি বাজারে সব ধরনের মাছের দাম ৪০-৬০ টাকা বেড়েছে। আর সব থেকে বেশি বেড়েছে ছোট মাছের দাম। কোনো ছোট মাছ মিলছে না ৫৫০ টাকার নিচে।  

ইফতারসামগ্রীর দাম চড়া : বাড়তি দামে বিক্রি হয়েছে মুড়ি, চিড়া, গুড়সহ বিভিন্ন ইফতারসামগ্রী। গতকাল প্রতি কেজি খোলা মুড়ি ২০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে। আবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মুড়ির দাম একেকরকম। রামপুরা বাজারে ৬৫ টাকায় পাওয়া গেলেও ওই মুড়ি সেগুনবাগিচার আল্লাহর দান স্টোরে বিক্রি হয় ৭০ টাকায়। মতিঝিল স্টাফ কোয়ার্টারের বাজারে তা আবার ৮০ টাকা।  

এ ছাড়া কয়েক দিন আগে যে চিড়া ৭০ টাকা ছিল তা এখন ৮৫ টাকা। খেজুরের গুড় বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৫০ ও আখের গুড় ৮০-১০০ টাকায়।  

কথা রাখেননি ব্যবসায়ীরা : রমজান এলেই সরকার ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর প্রতিবারই ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দেন, জিনিসের দাম বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সরকার ও ব্যবসায়ীদের এসব কার্যকলাপ লোক দেখানো বলে প্রমাণিত হয়। ভোক্তারা বলছে, রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানো ব্যবসায়ীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সরকার তা দেখেও দেখে না।  

জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরবরাহ ঘাটতির কারণে কোনো পণ্যের দাম কম-বেশি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে একক আধিপত্য আছে এমন কিছু কোম্পানি পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। তারাই বাজারের নিয়ন্ত্রক।  

তিনি বলেন, শুধু বড় করপোরেটরা নয়, এখন ছোটবড় আড়তদার, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজারে সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলেছে। এসব ভাঙতে হবে। আর সেজন্য সরকারি নজরদারির বিকল্প নেই।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!