• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাশের বহরে কাঁদছে মাটি


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ২৬, ২০১৯, ০১:৪২ পিএম
লাশের বহরে কাঁদছে মাটি

ঢাকা : এ কোন বাংলাদেশ? যেখানে প্রায় প্রতিদিন লাশের মিছিল হয় সড়কে। নিরীহ সাধারণের নৃশংস মৃত্যুর মিছিলেও নড়ে ওঠে না দায়ীদের চেয়ার। আইপি, ভিআইপি আর ভিভিআইপিদের সামান্য দুর্ঘটনার আঁচড়েও অনেক কিছু হয়ে যায়।

প্রতিদিনই সংখ্যায় দশের ঊর্ধ্বে নিরপরাধ মানুষকে অসচেতনতা আর আইনের দুর্বলতায় প্রাণ হারাতে হচ্ছে। নতুন আইন করেও কার্যকর ফল পাওয়া যাচ্ছে না আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে। দুর্ঘটনাকে কতদিন স্বাভাবিক ধরে নেবে দেশবাসী? লাশের চূড়া কত উঁচু হলে আইনের ফল পাবে মানুষ? এসব প্রশ্ন দেশবাসীর।

মহাসড়ক, জেলা সড়ক, উপজেলা সড়ক সব সড়কেই প্রতিদিন লাশের মিছিল। আজ এ জেলায় তো কাল ওই জেলায়। লাশের বহরে কাঁদছে মাটিও। প্রতিদিন বাংলার কোনো না কোনো ঘরে চলে আহাজারি। এ কান্না, এ আহাজারি আর কতদিন চলবে? কান্না থামাবে কে? কেউ কি দায় নেবে না এর?

বিদায়ী বছরের ৩ এপ্রিল রাজধানীর কারওয়ানবাজারে কলেজছাত্র রাজীবের বিচ্ছিন্ন ডান হাত দুই বাসের মাঝে আটকে থাকার ছবি কাঁদিয়েছে দেশবাসীকে। মর্মন্তুদ এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ২০ এপ্রিল রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রথমে পা হারায় গৃহকর্মী রোজিনা, পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। এরপর ২৯ জুলাই কুর্মিটোলায় হোটেল রেডিসনের সামনে জাবালে নূর পরিবহন নামের বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে।

দেশব্যাপী গড়ে ওঠে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। এই আন্দোলন প্রশমনে সরকারের উদ্যোগ ও দাবি পূরণে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় ২৭ আগস্ট চট্টগ্রামের সিটি গেট এলাকায় বাসে অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে বিতর্কের জেরে রেজাউল করিম রনি নামে এক যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে হত্যার অভিযোগ ওঠে। পরের দিন কুষ্টিয়া শহরে রাস্তা পার হওয়ার সময় বাসের ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে পড়ে নিহত হয় শিশুকন্যা আকিফা। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। নৈরাজ্যের সড়কে প্রাণহানি আর রক্তক্ষরণ চলছেই।

সর্বশেষ শুক্রবার (২৫ জানুয়ারি) কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি ট্রাক উল্টে প্রাণ গেছে ১৩ শ্রমিকের।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, বিদায়ী ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭ হাজার ২২১ জন, আহত হন ১৫ হাজার ৪৬৬ জন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলনের পরও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। সড়কে চলাচল সঙ্কেত ঠিক নেই। ফিটনেসবিহীন যানবাহনও চলছে দেদার। চালকের বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ হয়নি। উপরন্তু দাবি আদায়ে বহাল আছে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর যখন তখন যাত্রীদের জিম্মি করার পুরনো কৌশল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মো. শামসুল হক টেলিফোনে বলেন, ছাত্র আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন আইনটি হওয়া একটা অর্জন। কিন্তু গণপরিবহনের শৃঙ্খলা ফেরেনি। আরো অনেক কাজ করতে হবে। আইনটি বাস্তবায়ন করতে হবে। হাইওয়েগুলোয় সড়ক বিভাজক দিতে হবে। রাস্তা যাতে চালকদের কাছে দৃশ্যমান হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি বলেন, কার্যকর ও দৃশ্যমান উন্নতি না হলে সড়কে প্রাণহানি বন্ধ হবে না। কমবেও না। হয়তো সাময়িক এক-দুই মাস উন্নতি হবে।

বেহাল মহাসড়কের বিষয়টি বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের বক্তব্যেও উঠে আসে গত বছরের শেষ দিকে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশনে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, ‘ঢাকা থেকে বের হলে আপনি বুঝবেন না, আপনি চট্টগ্রামে যাচ্ছেন, নাকি সিলেট যাচ্ছেন, নাকি আবার ঢাকা ফিরে আসছেন। সড়কে এ-সংক্রান্ত কোনো সিগন্যাল বা নির্দেশক নেই।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর তথ্য অনুসারে, বর্তমানে সারা দেশে যানবাহন আছে ৩৫ লাখের কিছু বেশি। মোটরযান আইন অনুযায়ী চাকা, ইঞ্জিনক্ষমতা ও ধরন বিবেচনায় নিয়ে ৪০ ধরনের যানের নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। কারসহ অবাণিজ্যিক যানবাহনের ক্ষেত্রে তৈরির সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের ফিটনেস সনদ একসঙ্গেই দেওয়া হয়। বাস, ট্রাকসহ যানবাহনের ফিটনেস সনদ নিতে হয় প্রতিবছর। সারা দেশে মোটরসাইকেল আছে ২২ লাখ ৪০ হাজার।

বিআরটিএ’র কর্মকর্তারা বলছেন, ১০ শতাংশ গাড়ি নতুন। ফলে কমবেশি পৌনে ১২ লাখ যানবাহনের প্রতিবছরই ফিটনেস সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেক পরিবহন মালিকরা প্রভাব ঘাটিয়ে সনদবিহীন গাড়ি চালাচ্ছেন। নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুরু হলে কিছুদিন ফিটনেস সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে। এখন আর সেই অবস্থা নেই বলে। ফলে আগের সেই করুণ দশাই ফিরে এসেছে।

বিআরটিএ’র হিসাবে, বর্তমানে লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা প্রায় ১৯ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ১৬ লাখ যানবাহন চলছে ভুয়া চালক দিয়ে। অবশ্য কিছু কিছু চালকের একাধিক শ্রেণির লাইসেন্স রয়েছে। এটা হিসাবে ধরলে লাইসেন্স আছে ২৬ লাখের কিছু বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালিকানা, চলাচল ব্যবস্থায় গলদ আছে। পথচারীরাও সচেতন নন। সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা। এটা এক সপ্তাহ বা এক মাসের পরিকল্পনা-কর্মসূচি দিয়ে ঠিক হবে না। লাগাতার পদক্ষেপ জরুরি।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় বিমানবন্দর সড়কে দুই কলেজ শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। সরকারি সংস্থাগুলো বলেছিল, শিশুদের এই আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। সড়কে চলমান বিশৃঙ্খলা আর অনিয়ম বন্ধে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ, ছিল নানা প্রতিশ্রুতিও। তবে চোখ খুলে দেওয়ার পরও সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মিছিল থামেনি।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, ২০১৮ সালে রেলপথে ৩৭০টি দুর্ঘটনায় ৩৯৪ জন নিহত এবং ২৪৮ জন আহত হয়, নৌপথে ১৫৯টি দুর্ঘটনায় ১২৬ জন নিহত ও ২৩৪ জন আহত এবং ৩৮৭ জন নিখোঁজ হয়েছে, আকাশপথে ৫টি দুর্ঘটনায় ৫৫ জন নিহত এবং আহত হয়েছে ৩২ জন। সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশপথে সম্মিলিতভাবে ৬ হাজার ৪৮টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭৯৬ জন নিহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় ১৫ হাজার ৯৮০ জন আহত হয়েছেন।

গত বছরের ২৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সড়ক নিরাপত্তায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেন। এ ছাড়াও নতুন সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার করা হয়েছে।

বিদায়ী বছরে ১ হাজার ২৫২ জন চালক-শ্রমিক, ৮৮০ জন শিক্ষার্থী, ২৩১ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৭৮৭ জন নারী, ৪৮৭ জন শিশু, ১০৬ জন শিক্ষক, ৩৪ জন সাংবাদিক, ৩৩ জন চিকিৎসক, ৯ জন প্রকৌশলী, ২ জন আইনজীবী এবং ১৯২ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মী সড়কে দুর্ঘটনার শিকার হন। দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৫০টি যানবাহনে পরিচয় মেলে। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ বাস, ২৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান, ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ কার-জিপ-মাইক্রোবাস, ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ অটোরিকশা, ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ মোটরসাইকেল, ৩ দশমিক ৭২ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ নসিমন করিমন ও হিউম্যান হলার সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।

দুর্ঘটনাগুলোর ৪১ দশমিক ৫৩ শতাংশ গাড়িচাপা, ২৯ দশমিক ৭২ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬ দশমিক ১৮ শতাংশ খাদে পড়া, শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ ট্রেনের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে ঘটে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পরিবহন খাতে জবাবদিহি নিশ্চিত না করতে পারায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। সরকার তাড়াহুড়ো করে সড়ক পরিবহন আইন পাস করলেও তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিচ্ছে না। পরিবহন খাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার লোকজন, পুলিশ, পরিবহন মালিক, শ্রমিকদের নিয়ে দুর্নীতির দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। এই চক্র চায় না পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজ্জামেল হক চৌধুরী বলেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তায় অব্যবস্থাপনা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, মাদক সেসব, মোবাইলে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালানোসহ পথচারীদের অসতর্কতায় দুর্ঘটনা ঘটছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!