• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শত বছরের নৌকায় ভাসমান হাট


বরিশাল প্রতিনিধি জুলাই ৩, ২০১৬, ০৫:৪৬ পিএম
শত বছরের নৌকায় ভাসমান হাট

একের পর-এক নৌকা আসছে আর যাচ্ছে। একেকটাতে একেক রকমের পণ্য। নৌকায় করে সবজি, ফল, ধান, চাল, ডালসহ নানান ফসল নিয়ে ঘাটে আসছেন দূর-দূরান্তের মানুষজন। বিকিকিনি করে আবার নৌকা বেয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা। হঠাৎ করে দেখে নদীতে ভাসমান এ হাটকে ব্যাংককের ভাসমান বাজারের মতোই মনে হয়। তবে নৌকার এ ভাসমান হাট তার চেয়ে অনন্য ও ঐতিহ্যের।

বৃহত্তর বরিশালের ঝালকাঠি সদর উপজেলা, পিরোজপুরের স্বরুপকাঠী (নেছারাবাদ) ও বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, উজিরপুরের হারতার বেশ কিছু এলাকাজুড়ে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এমন একাধিক ফ্লোটিং মার্কেট বা ভাসমান হাট যেন জলের এক স্বর্গরাজ্য।

ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। এ কথাতো অনেকেই জানেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এ নদী ও খালের মধ্যে কী অপরিসীম স্বর্গীয় সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। সব কিছুই যেন ছবির মতো মনে হয়। কবির ভাষায় “দেখা হয়নায় দু’চোখ মেলিয়া-ঘর হতে দু’পা ফেলিয়া”। পানিপ্রধান অঞ্চল বলে স্বভাবতই এখানকার জীবনযাত্রায় নৌকার ভূমিকা প্রবল। কতটা প্রবল তা সরেজমিনে কেউ না আসলে বোঝা যাবে না। কিছু কিছু এলাকার অধিবাসীদের বাণিজ্যের বেশ বড় একটি অংশ চলে জলে বসে। আর এ কারণেই বরিশাল, পিরোজপুর আর ঝালকাঠিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভাসমান হাট-বাজার।

জেলার বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বসে বিশাল ধান আর চালের ভাসমান হাট। খুব সকাল থেকেই কয়েক’শ নৌকায় করে কারবারি ও গৃহস্থরা ধান, চাল নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। অনেকে আসে খালি নৌকা নিয়ে চাল ক্রয়ের জন্য। পুরো প্রক্রিয়াটাই চলে নদীতে বসে। ধানের বাজার ছাড়াও রয়েছে ভাসমান সবজির হাট। নাজিরপুরের বৈঠাকাঠা, উজিরপুরের হারতা, মাহমুদকাঠিসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় রয়েছে ভাসমান সবজির বাজার। এখানেও স্থানীয় মানুষজন তাদের শাকসবজি নৌকায় করে নিয়ে এসে নৌকায় বসেই বিক্রি করে থাকেন। সকাল থেকেই জমে ওঠে এ বাজার। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লাল শাক, পালং শাক, পুঁই শাক, কলা, চিচিংগা, বরবটি, শশা, টমেটো, ঢেড়শ, মুলা ইত্যাদি নানাধরনের সবজি দিয়ে ভরপুর থাকে এসব নৌকায়। শান্ত জলের মাঝে সবজি বোঝাই নৌকাগুলোতে বেচাকেনা চলে হরদম।

কোন বারে কোন হাট-বানারীপাড়া উপজেলা সংলগ্ন সন্ধ্যা নদীতে ভাসমান চালের হাট বসে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার। উজিরপুরের হারতার ভাসমান সবজির বাজার বসে প্রতি রবি ও বুধবার। নাজিরপুরের বৈঠাকাঠার ভাসমান সবজির হাট বসে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার। আটঘর, কুড়িয়ানা ও ভিমরুলির ভাসমান পেয়ারা বাজার বসে প্রতিদিন (জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে)।

এরমধ্যে ঝালকাঠির সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি, পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের আটঘর ও কুড়িয়ানা এলাকার বিভিন্ন খালের ভেতরে অবিস্থত ভাসমান হাটগুলো মৌসুমী ফসল ও শাক-সবজির জন্য বিখ্যাত। সব বাজারই খুব সকালে বসে এবং দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। স্বাভাবিক সময়ে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে নদী ও খালে বসে এ ভাসমান হাট। তবে ফল-ফসলের মৌসুমে প্রতিদিনই ভাসমান এ হাটগুলো জমে ওঠে। তবে পেয়ারা বা আমড়ার মৌসুমে আটঘর-কুড়িয়ানার ভাসমান হাটগুলো বেশি জমজমাট থাকে। এসব হাটের ক্রেতারা মূলত পাইকার নামে পরিচিত। ফলে ভাসমান এসব হাটে খুচরা ক্রেতারা তেমন গুরুত্ব পায় না। হাটবারে বড় বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে এসব হাটে আসেন পাইকাররা।

হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভোর ছয়টার পর থেকেই পুরোদমে শুরু হয় ভাসমান হাটে বিকিকিনি। সকাল ১০টার পর বেচাকেনা তেমন থাকে না। পেয়ারা, আমড়া ও অন্যান্য ফলের মৌসুমে সময়ের ভিন্নতা দেখা দেয়। তখন হাটগুলো সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত জমজমাট থাকে। এসব ভাসমান হাট থেকে মৌসুমী ফল, ফসলসহ বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করে পাইকাররা ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে নিয়ে যায়। আবার অনেক সময় কাঁচামাল থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার লোকজনও এসব বাজার থেকে পণ্য কিনে নিয়ে যায়।

অপরদিকে দেশের শস্যভান্ডার বলেখ্যাত বরিশাল অঞ্চলে স্বল্প খরচে উৎপাদিত ফল-ফসল খুব সহজেই ভাসমান হাটের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন। ফলে ক্রমেই ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশাল অঞ্চলে ফসল ও ফলের চাষাবাদে বিপ্লব ঘটছে।

বর্তমানে এ অঞ্চলের মানুষের বাড়ির পাশে কোনো পতিত জমি নেই বললেই চলে। এলাকার বেকার যুব-সমাজ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন বিভিন্ন ফসল চাষাবাদে ঝুঁকছেন। আটঘর-কুড়িয়ানা ও ভীমরুলির ভাসমান হাটে যেসব পণ্য বেচাকেনা হয় তারমধ্যে রয়েছে, বোম্বাই মরিচ, কাচা মরিচ, ডাব, নারকেল, লেবু, কচু, কচুরলতি, পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, পেয়ারা, কাচাকলা, আমড়া, বিভিন্ন ধরনের শাক ও আলু। এরমধ্যে কোনো ফসলই নির্ধারিত পিস বা ওজনের (সর্বনিন্ম এক’শ পিস বা পাঁচ কেজি) নিচে বিক্রি হয়না। নৌ-পথ বেষ্টিত এ অঞ্চলে প্রতি হাটবারে কমপক্ষে ৫ শতাধিক নৌকায় করে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আসেন বলে জানিয়েছেন, আটঘরের ইজারাদার সুমন হাওলাদার।

ঐতিহ্যের সাথে এসব হাট এখন দেশি-বিদেশী পর্যটকসহ সব মানুষের কাছে দর্শনীয়স্থান হিসেবেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। বরিশালের সন্ধ্যা নদীতে ধান-চালের ভাসমান হাটে বিভিন্ন জাতের ধান ও চাল ছাড়া অন্য কোনো পণ্য পাওয়া যায় না। প্রতি হাটবারে সকাল সাতটা থেকে সর্বোচ্চ বেলা ১১টা পর্যন্ত এ হাট জমজমাট থাকে। সন্ধ্যা নদীর এ হাটের সাথে জড়িত রয়েছেন কুইট্টালরা (স্থানীয়ভাবে ধান ভাঙ্গার কাজ করেন যারা)। তারা ধান থেকে চাল তৈরি করে ভাসমান এ হাটে বিক্রি করেন। তবে সন্ধ্যা নদীর হাটের নৌকাগুলো আটঘর-কুড়িয়ানা, ভীমরুলি হাটের মতো আকারে ছোট নয়। এগুলো একটু বড় ধরনের নৌকা। যারমধ্যে ধানের একটি ডোলা বসানো থাকে। ডোলার মধ্যেই ধান-চাল রাখা হয়। আর নৌকার ওপরেই বেতের দাঁড়িপাল্লায় করে সনাতন পদ্ধতিতে ধান-চাল পরিমাপ করে বেচাকেনা হয়।
আকবর হোসেন নামের এক পাইকার জানান, এখনো এ হাটে শত শত মণ ধান ও চাল আসে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতি ভালোই থাকে। তবে আগে এ হাট বালাম চালের জন্য বিখ্যাত ছিল, এখন আর তা নেই। তিনি জানান, হাটের পুরাতন স্থানটিতে চর পড়ে গেছে, এখন বাইরে থেকে আসা ক্রেতাদের নৌকায় করে দূরে গিয়ে ধান ও চাল দেখতে হয়।

ভাসমান পেয়ারা বাজার-

বাংলাদেশের ভাসমান পেয়ারা বাজার বসে জলের দেশ বরিশালের ঝালকাঠী ও স্বরূপকাঠীর বিভিন্ন জায়গায়। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ভিমরুলি, আটঘর, কুড়িয়ানা বাজার। অনেকে এই ভাসমান বাজার সমুহকে থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেটের সাথে তুলনা করে থাকেন। জুলাই থেকে আগস্ট মাসের প্রতিদিনই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েক হাজার মন পেয়ারা বিকিকিনি হয় এসব ভাসমান হাটে। পেয়ারার বাজারের সাথে রয়েছে, মৌসুমী ফল আমড়া, চালতা, বিলাতি গাব, কলা, সুপারিসহ নানা ধরনের সবুজ তরকারির ভাসমান পসরা।

নৌকার ভাসমান হাট-

নৌকার হাট মানে নৌকার ওপর বাজার নয়; নতুন নৌকা কেনা বেচার জন্য খালের পাড়ে সারি সারি শত শত নতুন নৌকা সাজানো রয়েছে। চলছে বর্ষাকাল। চারিদিকে বর্ষার পানিতে টুইটুম্বর। আর এসময় দক্ষিণের মানুষের অন্যতম বাহন হয়ে ওঠে নৌকা। আর সাধারণ মানুষের এই চাহিদার কথা চিন্তা করেই আটঘর কুড়িয়ানা ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠীতে শত বছরের বেশি সময় ধরেই বসছে নৌকার ভাসমান হাট।

বাঁশের চাঁইয়ের ভাসমান হাট-

বর্ষাকালে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় দেশি প্রজাতির মিঠাপানির মাছ শিকারের জন্য ব্যবহার করা হয় বাঁশের তৈরি বিশেষ ফাঁদ (চাঁই)। গ্রামাঞ্চলে মাছ ধরার সবচেয়ে আদি উপকরণের মধ্যে একটি হচ্ছে বাঁশের তৈরি চাঁই। গ্রীস্মের শুরু থেকে গ্রামাঞ্চলের খাল-বিল ও নদী-নালায় চাঁই দিয়ে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। যা চলতে থাকে ভাদ্র-আশ্বিন ও কার্ত্তিক মাস পর্যন্ত। উপকূলের বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে মাছ ধরার এ উপকরণটির বাজারজাত ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিন বাজারে হাজার হাজার চাঁই বিক্রি হচ্ছে। পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার পোনা নদী তীরবর্তী দক্ষিণ বাজার, ভুবনেশ্বর খালে শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে আজো টিকে আছে ভাসমান চাঁইয়ের সবচেয়ে বড় মোকাম। সপ্তাহে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এ দু’দিন ভান্ডারিয়ায় ভাসমান চাঁইয়ের হাটের দিন থাকায় এখান থেকে পাইকারী দরে ক্রয়ের পর ব্যবসায়ীরা গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন ছোট হাট-বাজারে এসব চাঁই বিক্রি করেন।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!