• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শবে বরাতের রাতেও যাদের দোয়া কবুল হয় না


ধর্মচিন্তা ডেস্ক এপ্রিল ২১, ২০১৯, ০৬:৫৬ পিএম
শবে বরাতের রাতেও যাদের দোয়া কবুল হয় না

ফাইল ছবি

ঢাকা: মাহে শাবান অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। আর ১৪ শাবান দিবাগত রাত (শবেবরাত) সবিশেষ ফজিলতপূর্ণ, বরকতময় মহিমা, স্বাতন্দ্র্যমণ্ডিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ রাতটিকে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (অর্ধশাবান রাত) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে এই রাতটি শবে বরাত তথা মুক্তি, নিষ্কৃতি, পাপ মোচনের রাত নামেই সমধিক খ্যাত।

মাহে শাবানের সূচনা থেকেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। কিন্তু সমাজের প্রবল প্রথাগত, আড়ম্বরপূর্ণ উদযাপন ও রেওয়াজি সংস্কৃতিতে শবে বরাতের প্রকৃত মাহাত্ম্য, মর্যাদা ও পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে কি না এ নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। আর এ জন্য শবে বরাতের প্রকৃত গুরুত্ব ও তাৎপর্য, ফজিলত, মাহাত্ম্য ও করণীয় এবং বর্জনীয় সম্পর্কে সবার সম্যক জানা থাকা একান্ত আবশ্যক।

শবে বরাতের ফজিলত

অসীম কল্যাণে ভরপুর এই শবে বরাতের রজনী বান্দার জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ এক নিয়ামত।এ রাতে মহান রাব্বুল আলামীন মাখলুকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেন, দয়ার সাগরে ঢেউ উঠে, মাগফিরাতের দ্বার উম্মোচিত হয় পাপি-তাপি সব বান্দার জন্য।

নিম্নে শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো।
ইরশাদ হয়েছে-

عن حضرت على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الا من مستغفر فاغفرله الا مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر

অর্থ: ‘হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত. মহা নবী (সা.) ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাছ নাযিল করেন। অতঃপর ঘোষণা করেন, ‘কোনো ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।’ ‘কোনো রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করব।’ ‘কোনো মুছিবতগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তার মুছিবত দূর করে দিব।’ এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)

যদি শবে বরাতের ফজিলতের ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো হাদিস নাও থাকতো, তবে এই হাদিসটিই এ রাতের ফজিলত সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এবং এ রাতে মাগফেরাতের উপযোগী নেক আমলের গুরুত্ব প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট হত। অথচ হাদিসের কিতাবসমূহে এ বিষয়ক আরো একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

যেমন হাদিসে আরো এসেছে, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন- এক রাতে রাসূল (সা.) কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। মহানবী (সা.) বললেন- কি ব্যাপার আয়েশা, তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? হযরত আয়েশা (রা.) বললেন- আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্যকোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসূল (সা.) তখন বললেন- যখন শাবান মাসের ১৫ই রাত আসে তখন আল্লাহ পাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমিযী)

মুআয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, এ রাতে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের দ্বারা ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হয়। কিন্তু শিরকি কাজকর্মে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী মানুষ এই ব্যাপক রহমত ও সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত থাকে। যখন কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাত ঘোষণা হয়, তখন তার অর্থ এই হয় যে, এই সময় এমন সব নেক আমলের ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে যার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের উপযুক্ত হওয়া যায় এবং ওইসব গুণাহ থেকে বিরত থাকতে হবে, যার কারণে আল্লাহ তা’য়ালার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাত থেকে বঞ্চিত হয়।

মহানবী (সা.) আরো বলেন-

*রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস, আর রমজান আল্লাহর সকল বান্দাদের মাস। (মা‘সাবাতা বিস সুন্নাহ)
*রজব এবং রমযানের মধ্যবর্তী মাসের নাম শা’বান মাস। লোকেরা এই মাসের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করে না। অথচ এই মাসটিতে বান্দার আমল আল্লাহর নিকট পেশ করা হয় এবং আমল সমুহের অধিক ছওয়াব দান করা হয়। আমি ভালোবাসি যে, আমার আমল আল্লাহর হুযুরে রোযা রাখা অবস্থায় পেশ করা হোক। (মা সাবাতা বিস সুন্নাহ)

মাসদ্বয়ের জন্য মহানবী (সা.) এভাবে দু’আ করতেন-اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان
‘আল্লাহ্ম্মুা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শা’বানা ওয়া বাল্লিগনা ইলা রামাদান। অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ রজব ও শা’বান মাসে আমাদের জন্য রবকত নাযিল করুন, আর আমাদেরকে রমযান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।

দোয়া কবুলের রাত
যে পাঁচটি রাতে বিশেষভাবে দোয়া কবুল হওয়ার ওয়াদা করা হয়েছে তার মধ্যে শবে বরাতের রাত একটি,
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন-

ان الدعاء يستجاب فى خمس ليال اول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة القدر المباركة وليلتى العيدين

অর্থ : ‘নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রিতে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে থাকে। (১) রজব মাসের প্রথম রাতে, (২) শবে বরাতের রাতে, (৩) ক্বদরের রাতে, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতে, (৫) ঈদুল আযহার রাতে।’ (মা-ছাবাতা বিসসুন্নাহ)

শবে বরাতের রজনীতেও যাদের দোয়া কবুল হয় না

কিন্তু শবে বরাতের রাতেও নিম্নবর্ণিত লোকদের দোয়া ও আমল (খাটি অন্তরে তওবা না করা পর্যন্ত) কবুল হয় না।
(১) মুশরিক (২) মাতা-পিতার অবাধ্য সন্তান (৩) আত্মীয়দের সাথে ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া সম্পর্ক ছিন্নকারী (৪) জালিম শাসক ও তাহাদের সহযোগী, (৫) না হক হত্যাকারী (৬) পরনারীগামী (৭) মদ্যপানকারী (৮) ইর্ষাপরায়ণ (৯) নিন্দাকারী (১০) গনক ও রেখা টানিয়া অথবা ফালনামা দেখিয়া ভাগ্য ও ভবিষাৎ শুভাশুভ নির্ধারণকারী (১১) গায়ক ও বাদক (১২) মিথ্যা শপথের সাহায্যে পণ্য বিক্রয়কারী (১৩) পায়ের গিরার নিচে গর্ব সহকারে কাপড় পরিধানকারী (১৪) যাদুকর (১৫) পরস্পর শত্রুতা ভাব পোষণকারী (১৬) কৃপণ (১৭) অন্যায়ভাবে শুল্ক আদায়কারী (১৮) জুয়াড়ি (১৯) দাবা-পাশার খেলোয়াড় (২০) বিদআ’ত প্রচলনকারী (২১) মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী (২২) সুদ দাতা (২৩) সুদ গ্রহিতা (২৪) ঘুষ দাতা ও গ্রহিতা (২৫) সন্ত্রাস ও ফাসাদ সৃষ্টিকারী।

তাই শবে বরাতের পূর্ণ ফযিলত ও শবে বরাতের রাতে দোয়া কবুল হওয়ার জন্য উল্লেখিত কবীরা গুনাহসমূহ থেকে খাঁটি দিলে তওবা করা উচিত। অন্যথায় সারারাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করেও কোনো লাভের আশা করা যায় না।

মাগফিরাত ও বরকতের রাত
উপরে উল্লেখিত হাদীছ শরীফ-এর ব্যাখ্যায় ইমাম-মুজতাহিদগণ বলেন যে-
ليلة البراءة هى ليلة العفو والكرم، ليلة التوبة والندم، ليلة الذكر والصلوة، ليلة الصدقات والخيرات، ليلة الدعاء والزيارة، ليلة الصلاة على النبى صلى الله عليه وسلم، ليلة تلاواة القران الكريم
অর্থ: ‘বরাতের রাত্র হলো ক্ষমা ও দয়ার রাত্র, তওবা ও লজ্জিত হওয়ার রাত্র, যিকির ও নামাযের রাত্র, ছদক্বা ও দান-খয়রাতের রাত্র, দোয়া ও জিয়ারতের রাত্র, দুরূদ শরীফ পাঠ করার রাত্র এবং কোরআন শরীফ তিলাওয়াতের রাত্র।’

রমজানের অভ্যর্থনার রাত
শবে বরাতের এ রাতটিকে পবিত্র রমজানুল মোবারকের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে যেন রমজানের অভ্যর্থনার জন্যই রাখা হয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহ পর যে রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির মহান মাস আসন্ন, তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এ শবে বরাত। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র রমজানের মাধ্যমে তাঁর যে রহমতের দ্বার খুলে দেবেন, তার আগে একটি রাত রেখেছেন। এ রাতে তিনি বান্দাকে আহ্বান জানাচ্ছেন, তোমরা এ রাতে আমার সান্নিধ্যে এসে নিজেদের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করে নাও। যাতে আমার সঙ্গে তোমাদের একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। আর এ বন্ধন ও সম্পর্কের সূত্রে তোমরা যেন পবিত্র রমজানে আমার রহমত লাভে ধন্য হতে পারো। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, শবে বরাতকে পবিত্র রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে গ্রহণ করা।

বর্ণিত আছে, রজব মাসে চাষাবাদ করে ইবাদতের বীজ বপন কর, শাবান মাসে তাতে পানি দাও এবং রমজানে উহার ফসল কাট। মানুষ অভ্যাসের দাস। আগেভাগে নেক আমলের অভ্যাস না করলে হঠাৎ কোন বড় রকমের সাধনা বা পরীক্ষার সম্মুখীন হলে তাতে অকৃতকার্য হওয়ার আশঙ্কাই থাকে বেশি। কাজেই শাবান মাসের আমলনামায, রোজা, কোরআন শরীফ তেলওয়াতের প্রভৃতির গুরুত্ব অপরিসীম।

শবে বরাতের করণীয়
হজরত রাসুলে আকরাম (সা.) এর হাদিস থেকে জানা যায়, শবে বরাত উপলক্ষে করণীয় দুটি।
এক. রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করা। যেমন নফল নামাজ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দুরুদ, তওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদি।
দুই. পরদিন রোজা রাখা। এমনিতে সারা শাবান মাসেই অধিক হারে রোজা রাখা উত্তম। হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রায় সারা শাবান মাসেই রোজা রাখতেন। হজরত উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুলকে শাবান ও রমজান ছাড়া দুই মাস একাধারে রোজা রাখতে দেখিনি। (তিরমিজি)।

কিয়ামুল লাইল : বিভিন্ন হাদীসের বর্ননা থেকে শবে বরাতের রজনীর ইবাদতের ফজিলত ও তাৎপর্য বিষয়ে নির্দেশনা-ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নিম্নে এ বিষয়ে আরেকটি হাদিস পেশ করছি।
*হযরত আলা ইবনুল হারিস (রহ.) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।

শবে বরাতে বিশেষ পদ্ধতির আলাদা কোনো নামাজ নাই
একটি বিষয় খুব ভালোভাবে আমাদের বোঝা উচিত, শবে বরাতের কোনো নির্দিষ্ট নামাজ কিংবা আমলের কথা কুরআন ও হাদিসের কোথাও নেই। কোনো বিশেষ নিয়মনীতি নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। যেমন আমাদের মধ্যে অনেকে শবে বরাতের জন্য আলাদা নামাজ আছে বলে মনে করেন। তারা মনে করেন, এই নামাজের নিয়মনীতিও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ-জাতীয় ধারণা অবশ্যই ভিত্তিহীন।

তবে এ রাতে বেশি বেশি ইস্তিগফার করা, আল্লাহর কাছে স্বীয় গোনাহের মাফের জন্য কান্নাকাটি করা, দোয়া করা, কোরআন তিলাওয়াত করা। অনির্ধারিতভাবে নফল নামায পড়া, জিকির করা ইত্যাদী ইবাদত করা উত্তম ও ফযিলতপূর্ণ। এসবই নফল ইবাদত। করলে সাওয়াব হবে না করলে কোনো গোনাহ নেই। বরং শবে বরাতে আপনি যেভাবে ভালোবাসেন সেভাবেই আল্লাহকে ডাকুন। কারণ এ রাত একান্তই আপনার। আপন স্রষ্টার কাছে নির্জনে প্রাণ খুলে নিবেদন করুন নিজের সব চাওয়া ও পাওয়ার কথা। দুঃখ ও বেদনা এবং কষ্ট ও ভালোবাসার সব আর্তি ও ফরিয়াদ তাঁকে জানান নিঃসঙ্কোচে, তিনিই তো পরম আপন আমাদের, এমন আর কে আছে যার কাছে না চাইলে তিনি অসন্তুষ্ট হন!

তাই সারারাত কিংবা অর্ধরাত, নামাজ কিংবা শুধু তিলাওয়াত অথবা জিকির, যেভাবে আপনি ভালোবাসেন এবং যা আপনি নিজে শুদ্ধভাবে করতে জানেন, সেটুকুই করুন। পরম করুণাময় আল্লাহ তো আপনার অন্তর পর্যবেক্ষণ করছেন, কয় রাকাত নামাজ পড়ছেন কিংবা কতো টাকা দান করছেন, সেটি তার কাছে মোটেও বিবেচ্য নয়।
শবে বরাতের রোজা
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো কখনো অনেক নফল রোযা রাখতেন এবং আমরা (তাঁহার রোযা রাখার অবস্থা দেখে) বলতাম তিনি আর রোযা ভাঙবেন না। আবার কখনও বহুদিন রোযা রাখতেন না। আমরা বলতাম, (বোধ হয়) তিনি আর রোযা রাখবেন না। আমি রাসুলূল্লাহ (সা.) কে রমযান ব্যতীত অন্য কোন মাসের রোযা সম্পুর্ণ রাখতে দেখিনি । এবং শা’বান মাসের চেয়ে অধিক রোযা অন্য কোনো মাসে রাখতেও আমি দেখিনি ।

বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম বলেন, শাবান মাসটি রমজানের পূর্ববর্তী মাস হওয়ার কারণে বরকত ও পুণ্যময় একটি মাস, এ জন্য অন্তরকে পরিচ্ছন্ন করা এবং রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসুল (সা.) এ মাসে অধিক হারে রোজা রাখতেন। কিন্তু উম্মতের প্রতি একান্ত দয়াপরবশ হয়ে নবী (সা.) শাবানের শেষার্ধে নফল রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। এ জন্য বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম বলেন, যেসব লোক দুর্বল হওয়ার কারণে রোজা রেখে ক্লান্ত হয়ে যায়, তাদেরই উপরোক্ত হাদিসে শাবানের শেষার্ধে রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। যেন তারা এ ১৫ দিন খেয়ে দেয়ে রমজানের রোজার জন্য শক্তি সঞ্চয় করে এবং প্রফুল্ল চিত্তে রমজানের রোজা রাখতে পারে। (লুমআত)।
এ রাতের নফল আমলসমূহ সম্মিলিত নয়, ব্যক্তিগত।

এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে, এ রাতের নফল আমলসমূহ, বিশুদ্ধ মতানুসারে একাকিভাবে করণীয়। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যা কিছু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিস শরীফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামরে যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না।


এক হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ফরজ ছাড়া অন্য সব নামাজই বাড়িতে নির্জনে একাকী আদায় করাই উত্তম। তবে কোনো আহবান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না।

কোন কোন জায়গায় এই রেওয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা ইশার পর থেকেই ওয়াজ- নসীহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত খতমে-শবীনা হতে থাকে। উপরন্তু এসব কিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেয়া হয়।
মনে রাখতে হবে, এসব কিছুই ভুল রেওযাজ। শবে বরাতের ফাযায়েল ও মাসায়েল আগেই আলোচনা করা যায়। এ রাতে মাইক ছেড়ে দিয়ে বক্তৃতা-ওয়াজের আয়োজন করা ঠিক না। এতে না ইবাদতে আগ্রহী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করা সম্ভব হয়, আর না মসজিদে। অসুস্থ ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় আরামেরও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে।

শবে বরাত ও আমাদের সমাজ
সমাজের একশ্রেণির লোক ইসলামের দেওয়া সুস্থ-সুন্দর পদ্ধতির বিপরীতে নিজেদের কুরুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার আবিষ্কার করে থাকে। মহিমান্বিত এ রাতে যেখানে গুনাহ মাফ চাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন গুনাহে লিপ্ত হতে দেখা যায় এ শ্রেণির লোকদের।
শবে বরাত পালন বলতে আতশবাজি করা, হালুয়া-রুটির আয়োজন করা, বিশেষ পদ্ধতির নামায পড়াকে জরুরি মনে করা, এ রাতে গোসল করা ফযিলতপূর্ণ মনে করা, এ রাতে মসজিদে গিয়েই ইবাদত করাটা বাধ্যতামূলক মনে করা, ইত্যাদি বিদআত। শরীয়ত গর্হিত আক্বিদা ও কাজ। এসব করা জায়েজ নয়।

এ পর্যায় শবে বরাতের নামে সমাজে প্রচলিত কিছু শরীয়তবিরোধী আমলের চিত্র তুলে ধরা হলো যেন আমরা নিজেরা এগুলো থেকে বিরত থাকি এবং সমাজটাকেও এ সকল ইবাদতের নামে পাপাচার থেকে মুক্ত রাখতে পারি।
শবে বরাতকে কেন্দ্র করে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠা। অনেকে এ রাতে শোরগোল ও হৈচৈ করে থাকেন। উৎসবে মেতে ওঠেন। এটা সম্পূর্ণ বিদআত, হারাম । পবিত্র শাবান মাস ও শবে বরাত অধিক ইবাদতের উর্বর মৌসুম। শবেবরাত কোনো আনন্দ-উৎসবের সময় নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত লৌকিকতা, উন্মত্ততা, উৎসব প্রবণতায় শাবান ও শবেবরাতের প্রকৃত আবেদন এবং পবিত্রতা নষ্ট হয়।

আমরা যদি এ ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হই, তাহলে পবিত্র শবে বরাত পূজামণ্ডপের মতো নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে। অন্তরসারশূন্য হয়ে পড়বে। লোপ পাবে কাঙ্ক্ষিত রুহানিয়াত ও আত্মিকতা।
শবে বরাতে আতশবাজি করা
শবে বরাতে আতশবাজি করা শরীয়ত সম্মত নয়। আর এটা দ্বীন ইসলামের কোন শেয়ারের অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে আতশবাজি হিন্দু ধর্মের একটি ধর্মীয় প্রথার অন্তর্ভুক্ত। তাই মুসলমানের জন্য এসব করা সম্পূর্ণ রূপে হারাম ও নাজায়েয। কারণ হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
عن حضرت عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থ: ‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল বা সাদৃশ্য রাখবে তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।’ (আহমদ, আবূ দাউদ)
শবে বরাতে আলোকসজ্জা করা
শবে বরাতে আলোকসজ্জা করা শরীয়ত সম্মত নয়। ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আলোকসজ্জা হচ্ছে গ্রীক ধর্মের একটি ধর্মীয় প্রথা। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় প্রথা হিসেবে রূপ লাভ করে, যা শেষ পর্যন্ত দেয়ালী পূজা নামে মশহূর হয়। আলোকসজ্জা সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করে যা প্রকৃতপক্ষে দ্বীন ইসলামের শেয়ার বা তর্জ-তরীক্বার অন্তর্ভুক্ত নয়। শবে বরাতের আগমন উপলক্ষে মসজিদ, কবরস্থান ও বাসাবাড়িতে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। এর দ্বারা নিজের অর্থ অপচয় তো হয়ই উপরন্তু কাফেরদের সঙ্গে সাদৃশ্যতারও প্রতিফলন ঘটে। যা শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ বা হারাম।এ বিষয়ে নিম্নে বিজ্ঞ আলেমদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হলো।

* আল্লামা ইবন নুজাইম হানাফি বলেন, শবেবরাতে বিভিন্ন গলি ও বাজারে রংবেরঙের আলোকসজ্জা করা বিদয়াত, তেমনি মসজিদেও।
* শায়খ আলী মাহফুজও এরূপ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আল্লামা আবু শামা বলেন, বিদয়াতিরা যা থেকে বিষয়টি উদ্ভাবন করেছে এবং যদ্বারা তারা দ্বীনের সীমালঙ্ঘন করেছে, দ্বীনের মাঝে তারা অগ্নিপূজার রীতিনীতির আদলে যেটিকে চালু করেছে এবং নিজেদের দ্বীনকে ক্রীড়া ও আনন্দের বিষয়ে পরিণত করেছে তা হচ্ছে, শবে বরাত উপলক্ষে আলোকসজ্জা। যার সর্ব প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে বারামিকা জাতির মাঝে। এরপর তারা মুসলমানদের মাঝেও এটিকে প্রবেশ করিয়ে দেয়, মূলত অগ্নিপূজাই তাদের উদ্দেশ্য।

* হজরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন, যেসব জঘন্যতম বিদয়াত ভারতবর্ষে অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে, তন্মধ্যে রয়েছে (শবেবরাত প্রভৃতি উপলক্ষে) আলোকসজ্জা তথা বাসাবাড়ি, দেয়াল অট্টালিকা বৈচিত্র্যময় লাইট দ্বারা সজ্জিত করা, এর মাধ্যমে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া, আগুন নিয়ে আনন্দ খেলার লক্ষ্যে দলবদ্ধ হওয়া। যেগুলোর কোনো ভিত্তি বিশুদ্ধ কিতাবগুলোতে নেই। এ ব্যাপারে কোনো দুর্বল হাদিস কিংবা কমপক্ষে একটি জাল হাদিসও পাওয়া যায় না। ভারতবর্ষ ছাড়া অন্যান্য মুসলিম এলাকায়ও এর প্রচলন নেই।

চারিদিকে নিরাশা ও বিপদের এ কঠিন দুঃসময়ে বারবার অনুভূত হচ্ছে আল্লাহকে ডাকার ও তার কাছে আত্মসমর্পণের প্রয়োজনীয়তা। তিনি ছাড়া তো আমাদের আর কোনো সহায় নেই। শক্তি কিংবা বুদ্ধি দিয়ে নয়, তার সামান্য করুণার বর্ষণে ভেসে যাবে আমাদের সব মনোবেদনা ও জীর্ণতা। পবিত্র শবে বরাতের এ কল্যাণময় প্রহরে আমাদের এটুকু আত্মোপলদ্ধিই হতে পারে এক বিশুদ্ধ ও আলোকিত জীবনের নতুন সূর্যোদয়।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআই

Wordbridge School
Link copied!