• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শুদ্ধি অভিযানের গন্তব্য জানা নেই আ.লীগের


বিশেষ প্রতিনিধি অক্টোবর ১৫, ২০১৯, ০১:০০ পিএম
শুদ্ধি অভিযানের গন্তব্য জানা নেই আ.লীগের

ঢাকা : চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বিষয়ে আওয়ামী লীগের শুধু তৃণমূল পর্যায়ের নয়, কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও অনেকের স্পষ্ট কিছু জানা নেই। এর উদ্দেশ্য ও গন্তব্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মতো আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও অন্ধকারে আছেন।

অভিযান শুরুর প্রায় এক মাস হতে চললেও দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, পদবাণিজ্য ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীদের দলে ভেড়ানো ও তাদের প্রশ্রয়দাতা কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি, কোনো ব্যবস্থা নিয়ে দল ও সংগঠনকে বিতর্কমুক্ত করা হবে কি না এবং অভিযান আর কত দিন চলবে-এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও।

অভিযানের আসল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূলকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানানোও হয়নি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কয়েক নেতার ‘ধারণাগত বক্তব্য’ থেকে ক্ষমতাসীন দলের সারা দেশের নেতাকর্মীরা স্পষ্ট কোনো বার্তা পাচ্ছেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও গণমাধ্যমের কাছে অভিযানের বিষয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা হচ্ছে না।

 হঠাৎ অভিযানের কারণ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর মধ্যে যেমন জল্পনা-কল্পনা আছে তেমনই অভিযানের মূল লক্ষ্য ও গন্তব্য নিয়েও নানা কৌতূহল আছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে থেমে থেমে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের দেশ ছেড়ে পালানোর সুযোগ দলের ভেতর থেকেই কেউ কেউ করে দিচ্ছেন কি না, এ প্রশ্নও আছে নেতাকর্মীদের মধ্যে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘ক্যাসিনো বাণিজ্য চালানোর অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া অভিযানে সোমবার (১৪ অক্টোবর) পর্যন্ত সর্বশেষ গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বিতর্কিত কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান।

এ দুজনই একসময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকদের দল ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়। খালেদ যুবলীগে সংগঠনের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে আর পাগলা মিজান দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে দলে ভেড়েন বলে অভিযোগ আছে। খালেদ ও মিজান গ্রেপ্তার হলেও তাদের প্রশ্রয় ও মদতদাতাদের কিছুই হয়নি। এ নিয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মনে প্রশ্ন আছে।’

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য জানান, ‘দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা ও মন্ত্রী। ক্যাসিনো কারবার থেকে শুরু করে সারা দেশের সরকারদলীয় প্রায় সব বিতর্কিত সংসদ সদস্য ও নেতার আশ্রয়দাতা হিসেবেও পরিচিত তিনি। দলের চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ক্যাসিনো-কাণ্ডে দুজনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে। অভিযান তাদের পর্যায় পর্যন্ত চালানো হবে কি না, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অধিকাংশ নেতার স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।’

দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করার পরও যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে বহিষ্কার করতে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে সংগঠনটি। পিয়ন থেকে যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক হয়ে বিত্তবৈভব বানানো কাজী আনিসুর রহমান আত্মগোপনে চলে যাওয়ার প্রায় তিন সপ্তাহ পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত শুক্রবার তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। অভিযুক্ত এমন অনেক নেতাকে বহিষ্কার করতেও সংগঠনের নীতিনির্ধারকরা গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন।

ক্যাসিনো, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িতদের বহিষ্কারের বিষয়ে সংগঠনের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর এমন ভূমিকাকে নেতিবাচক চোখে দেখছেন দলের নেতাকর্মীরা। তাদের মনে অভিযান নিয়েও কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুবলীগের নেতাদের অপকর্মের পেছনে চেয়ারম্যানের মদতের বিষয়ে এত অভিযোগ উঠলেও এ পর্যন্ত শুধু তার ব্যাংক হিসাব তলব ও দেশের বাইরে যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। তার অবস্থান নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে।

সংগঠনের বহিষ্কারের জন্য গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার বিষয়ে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আত্মগোপনে থাকায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া যায়নি। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটকের পর বহিষ্কার করা হচ্ছে। এটি সংগঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত’।

সূত্রমতে, আগামী কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘শুদ্ধি অভিযানের’ পক্ষে আওয়ামী লীগ। সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত ও নাম ভাঙিয়ে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি করছেন যারা, তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তারের পাশাপাশি দল এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থেকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে দুইভাবে অভিযান চলতে থাকবে।

এর মধ্য দিয়ে বিতর্কিত, চাঁদাবাজ, অভিযুক্ত ও নানাভাবে অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিয়ে দলকে ‘বিতর্কমুক্ত’ করা যাবে বলে মনে করছে দলটি।

একই সঙ্গে দলে তরুণ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে সারা দেশের তৃণমূলের কমিটিতে ঠাঁই দেওয়া যাবে। অনেক এলাকায় দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চাপা থাকলেও তৃণমূলের কমিটি নির্বাচনের সময় দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়ে মাঠে গড়ানোর আশঙ্কা করেন অনেকে। অভিযান চলতে থাকলে দলের ‘আগাছা ও দুষ্কৃতকারীরা’ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে যেতে পারবেন না বলে তাদের ধারণা। তখন কমিটিও অনেকটা ঝামেলাযুক্ত হয়ে করা যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।

আগামী ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সম্মেলন হওয়া পর্যন্ত অভিযান চালু রেখে ও এর মধ্যে তৃণমূলের কমিটি নির্বাচন করে নতুন কমিটি নিয়ে নতুন বছরে পা রাখার পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।

নীতিনির্ধারক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগকে বিতর্কমুক্ত করতে ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে আরো গতি আনতে নতুন পরিকল্পনা করেছে দল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর গড়া ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এ দলের নেতৃত্বের সরকার আগামী ২০২০ সালে তার জন্মশতবর্ষ ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে।

এর আগেই দলকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশে দলের ভ্রাতৃপ্রতিম, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে ‘শুদ্ধ অভিযান’ চলছে।

তথ্যমতে, আওয়ামী লীগের সভাপতি দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেন গত ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত দলের যৌথ সভায়।
এর এক সপ্তাহ পর দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। সমালোচনা করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের দুই নেতার।

এরপর গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আওয়ামী লীগের অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!