• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে হবে


মো. নাঈম হোসেন জানুয়ারি ২২, ২০২০, ০১:২৫ পিএম
শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরাতে হবে

ঢাকা : ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের অভিজ্ঞতা এখনো বাংলাদেশ ভুলতে পারেনি। চিনচিনে ব্যথা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলার প্রচেষ্টায় ক্লান্ত সামগ্রিক বাজার অর্থনীতি।

২০১০ সালের পর বর্তমান শেয়ারবাজার সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চলছে পাল্লা দিয়ে টানা দরপতন। ৩৫০০ কোটি টাকা লোপাট। অন্যদিকে সর্বস্ব হারিয়ে ১১তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতির খবর ভাসছে নিউজফিডে।

কেননা বর্তমান অবস্থা এমন যে, শেয়ারবাজারে আস্থা নেই, ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা নেই। গ্লোবাল ইকোনমি ডটকমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাজার মূলধনের দিক দিয়ে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৮তম। তারপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের পুঁজি বাজারের অবস্থা হয়েছে আরো শোচনীয়।

২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৪ লাখ ১৩ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। আর গত ১৩ জানুয়ারি ২০২০ তা কমে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। থেমে থাকেনি পতন। পরদিন ১৪ জানুয়ারি মাত্র একদিনে বাজার পুঁজি হারিয়েছে আরো ৬ হাজার কোটি টাকা।

অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ শেয়ারবাজারের প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এ অবস্থার কারণ কী?

প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায় বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। কিন্তু এই আস্থার কথা তো শুনে আসছি বছরের পর বছর। তাহলে বিএসইসি, ডিএসই বা সিএসই কর্তৃপক্ষ কী করলেন এত দিনে!

নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ, নাসদাক-জাপান এক্সচেঞ্জ গ্রুপ, সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ, শেনঝেন স্টক এক্সচেঞ্জসহ বৈদেশিক স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর বাজার প্রবৃদ্ধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেখানে বাজার মূলধন বাড়ছে বই কমছে না। যার অন্যতম কারণ হলো যথাযথ আইন ও তার প্রয়োগ। অথচ আমাদের দেশে তার বিপরীত। আইন আছে কিন্তু যথাসময়ে যথাযথ প্রয়োগ দেখি না।

যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্ধেকটাই শেয়ারবাজার সমর্থিত। সেখানে আমাদের দেশে ১০ শতাংশের কম। আমাদের একদিকে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অকল্পনীয়, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে পারছে না বাজার অর্থনীতি।

কিন্তু এই দুটো একে অপরের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ফলে নেতিবাচক তথ্য যাচ্ছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। কেননা লোভনীয় জিডিপি দেখে তারা বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নেন না। বরং সংশ্লিষ্ট দেশের শেয়ারবাজারের বিভিন্ন সূচক ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর তথ্য পর্যালোচনা করে বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

সাধারণত বাজারে যখন অস্থিরতা দেখা দেয়, তখন বিনিয়োগকারীরা পুঁজি রক্ষায় ব্লু-চিপস বা ভালো মানের কোম্পানি শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু যখন ভালো মানের কোম্পানিগুলোর অবস্থাই শোচনীয়, সেখানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকাটাই স্বাভবিক। যার ফলে বাজারে দেখা দিচ্ছে পেনিক সেল (যখন অভিজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ সবাই শেয়ার বিক্রির প্রতিযোগিতায় নামে)। ঋণের টাকায় বিনিয়োগকারীদের পোর্টফলিও পড়ে যাচ্ছে ফোর্সড সেলের (জোরপূর্বক বিক্রি) আওতায়।

বাজার কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকারি মন্ত্রণালয়ের নানা পদক্ষেপও বলহীন বুলি হিসেবেই প্রমাণিত হচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা যখন নির্বাসনে, দুর্নীতি তখন স্বাভাবিক।

নড়বড়ে কোটারি, স্বজনপ্রীতি, স্বার্থান্ধতা, অদক্ষদের চেয়ার দখলের মরণ নেশা বর্তমান বাংলাদেশের হাজারও অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। হাজারো বিনিয়োগকারীকে তথা বাংলাদেশকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মাহুতির দিকে।

কিন্তু তা দেখার মতো হূদয়-চক্ষু কি কারো নেই! আসলে, যার আছে, তার ক্ষমতা নেই। আর যার ক্ষমতা আছে বা এটা দেখা যার দায়িত্ব, তার চক্ষু নেই।

বাজে কোম্পানিগুলো বাজারে আসছে, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করছেন, তারপর পুঁজি হারাচ্ছেন। এ যেন তিন বেলার ডাল-ভাতের মতো হয়ে গেছে। যা প্রভাব ফেলছে পুরো শেয়ারবাজারের ওপর। বিপাকে পড়ছে ভালো কোম্পানিগুলোও। সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে পুঁজি বাজারকে।
আস্থাহীনতা জেঁকে বসেছে বর্তমান বিনিয়োগকারীদের মাঝে। ঠিক যেন ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়ার মতো। অস্বাভাবিক দরপতনের কারণে সঠিক ফোরকাস্টিংও সম্ভব হয়ে ওঠে না। যা নতুন বিনিয়োগকে বিমুখ করছে। অনাকৃষ্ট করছে বিদেশি বিনিয়োগকেও।

কিন্তু এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী! পদক্ষেপসমূহ এভাবে সাজানো যেতে পারে— পুরো শেয়ারবাজারের দায়িত্বশীল চেয়ারকে ঢেলে সাজাতে হবে।

বিএসইসির শীর্ষ পদে এমন একজনকে বসাতে হবে যে হবে দক্ষ, সৎ, নির্ভীক এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর, আপসহীন দেশপ্রেমিক। শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণ যাতে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে জিম্মি হয়ে না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। কোটারী স্বার্থ তথা স্বজনপ্রীতি রোধে যথাযথ আইন প্রয়োগ করতে হবে। শুধু তদন্ত কমিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

শেয়ারবাজারকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নতুন ও পুরাতন কোম্পানিগুলোকে লিস্টিং/ডিলিস্টিংয়ের ক্ষেত্রে কঠোর আইনি প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনবোধে ননপারফর্মিং কোম্পানিগুলোকে তাদের ক্যাটাগরি পরিবর্তন করে তা ক্যাটাগরিতে নিতে হবে; সংবেদনশীল তথ্য পাচার রোধ করতে হবে। আর যা প্রকাশযোগ্য তা দ্রুত প্রকাশ করতে হবে।

গুজব রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে; বাজার নিয়ন্ত্রণে নতুন কাঠামো ও কৌশল উদ্ভাবনে বিশেষজ্ঞ দল গঠন করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বাজারে প্রবেশের পূর্বে বাজার ধারণাগত পূর্বশর্ত আরোপ করতে হবে। নিয়মিত প্রশিক্ষণবিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করতে হবে।  

সার্কিট ফিল্টার ও সার্কিট ব্রেকারকে যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ ও বাজারসংশ্লিষ্টদের নিয়ম মেনে চলতে উদ্বুদ্ধকরণে বার্ষিক সম্মাননা ঘোষণা করা যেতে পারে।  শেয়ারবাজারের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের বর্তমান তারল্য সংকটকে নিরসন করতে হবে। কেননা পুঁজিবাজারে অর্থের জোগান আসে বিভিন্ন ব্যাংক থেকেই এবং আস্থা অর্জনে আস্থাশীল হতে হবে।

নীতিনির্ধারকদের মাথায় রাখতে হবে যে, অর্থ দিয়ে আস্থা অর্জন করা যায় না। আস্থা আসে সততায়, গুণে, মানে, কর্মে, ব্যবহারে ও বিশ্বাসে।   
সর্বোপরি সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে তৎপর হতে হবে। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, একটা দেশের জীবনীশক্তি সরবরাহ করে মূলধন। আর তা আসে শেয়ারবাজার থেকে।

সুতরাং শেয়ারবাজার বা বিনিয়োগকারীরা বাঁচলে বাঁচবে বাংলাদেশ। মুজিববর্ষে আমাদের চাওয়া এটুকুই যে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে বাঁচাতে এখনই শেয়ারবাজারসহ অন্য সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করুন। দলমত নির্বিশেষে যোগ্যদের যোগ্য স্থানে মূল্যায়ন করুন। তাহলেই বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু প্রতিটি বাঙালির হূদয়ে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!