• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্বেতীর রোগের কোনো সম্পর্ক নেই কুষ্ঠ রোগের সঙ্গে


স্বাস্থ্য ডেস্ক নভেম্বর ১, ২০১৮, ০৬:৩৩ পিএম
শ্বেতীর রোগের কোনো সম্পর্ক নেই কুষ্ঠ রোগের সঙ্গে

ঢাকা : একজন মানুষের জন্মের পর কোনো কারণ ছাড়াই শরীরের বিভিন্ন স্থানের চামড়া সাদা হয়ে যাওয়াকে শ্বেতী রোগ বলা হয়। শ্বেতী রোগের সঙ্গে লিউকোডার্মার পার্থক্য রয়েছে। কারণ লিউকোডার্মার চিকিৎসা পর্যায়ে এটি শতকরা একশ ভাগ নিরাময়যোগ্য। এখানে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কারো শরীরের কোনো অংশ পুড়ে গেলে ঘা শুকানোর একপর্যায়ে স্থানটি সাদা হয়ে যায়। একে বলা হয় লিউকোডার্মা যা খুব সহজে নিরাময়যোগ্য। এই রোগের কারণ জানা থাকায় সহজেই এর চিকিৎসা করা যায়।

পশ্চিমা দেশগুলোতে সুনির্দিষ্ট জাতীয় নীতিমালা ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার মাধ্যমে শ্বেতী রোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। সেসব দেশে শ্বেতী রোগের আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি রয়েছে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা; কিন্তু আমাদের দেশে শ্বেতী রোগের ডায়াগনোসিস ও ব্যবস্থাপনায় একটি মারাত্মক বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

শ্বেতী রোগের কারণ - শ্বেতী রোগের প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়ে থাকে, একাধিক কারণে এই রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বংশগত প্রবণতাও এ রোগের সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা হয়।

বিভিন্ন ধরনের শ্বেতী  

১. ফোকাল শ্বেতী : এ ধরনের শ্বেতী রোগের ক্ষেত্রে সাধারণত শরীরের এক বা দুটি স্থানের চামড়া সাদা হয়ে যায়। মোট শ্বেতী রোগীর মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ এ ধরনের রোগী পাওয়া যায়। এ ধরনের রোগীর ২৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রোগটি আপনাআপনিই সেরে যায়। এ ধরনের শ্বেতীর চিকিৎসার ফল খুবই ভালো। আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে এ ধরনের রোগীর ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ফল পাওয়া যায় এবং ৬০ ভাগ রোগীই সম্পূর্ণ নিরাময় লাভ করে। এমনকি আমাদের দেশীয় একাধিক চিকিৎসাপদ্ধতি সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সংখ্যা ৮০ ভাগ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্য কয়েক মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। স্কিন গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমেও এর চিকিৎসা করা যেতে পারে।

২. সেগমেন্টাল শ্বেতী : সাধারণত এ ধরনের শ্বেতী শরীরের একটি অংশে দেখা যায়। আমাদের দেশে মোট শ্বেতী রোগীর মধ্যে ৩ শতাংশ এই শ্রেণির রোগী পাওয়া যায়। প্রকৃতিগতভাবে এটি স্থিতিশীল; কিন্তু আপনাআপনিই সেরে যাওয়ার কোনো প্রবণতা এ ধরনের শ্বেতী রোগের মধ্যে দেখা যায় না। আমাদের চিকিৎসাপদ্ধতিতে এ ধরনের রোগীর ৬৫ শতাংশের মধ্যে ইতিবাচক ফল পাওয়া যায় এবং রোগ নিরাময়ের হার ৪০ ভাগ। আমাদের দেশীয় বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি সমন্বয়ের মাধ্যমে এ ধরনের শ্বেতী রোগের নিরাময়ের হার ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। রোগ নিরাময়ে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। স্কিন গ্রাফটিংয়ের জন্য এ ধরনের রোগী বিশেষ উপযুক্ত।

৩. অ্যাক্রোফেসিয়াল শ্বেতী : এ ধরনের শ্বেতী রোগীর হাত-পায়ের উপরে নিচে, আঙুলের ডগা, কব্জি, কনুই, অ্যাংকেল, হাঁটু, ঠোঁট, চোখের চার পাশে, মুখ ও যৌনাঙ্গে সাদা দাগের সৃষ্টি হয়। মোট শ্বেতী রোগীর মধ্যে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত এ ধরনের রোগী দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবে এটি স্থিতিশীল ধরনের হলেও অনেক সময় অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এটি শরীরের ব্যাপক অংশে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের চিকিৎসায় এ ধরনের রোগীর প্রতি ওষুধ প্রয়োগের পর কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় খুবই ধীরে। এই হার ৫০ শতাংশ এবং রোগ নিরাময়ের হার মাত্র ৩০ শতাংশ। তবে বিরাজমান বিভিন্ন চিকিৎসাপদ্ধতি সমন্বিতভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে নিরাময়ের হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এই শ্রেণির শ্বেতী নিরাময়ে কয়েক বছর চিকিৎসা লেগে যেতে পারে। তবে অনেক ক্ষেত্রে শরীরের অল্প কিছু স্থানে এটি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে বিধায় স্কিন গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমেও এ ধরনের রোগীর চিকিৎসা করা যায়। তবে এটা করতে হবে অত্যন্ত দক্ষ সার্জনের মাধ্যমে।

৪. ভালগারিস শ্বেতী : এ ধরনের শ্বেতীতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বুক, পেট, পিঠ, ঘাড়, মাথা ইত্যাদি স্থানে ব্যাপকভাবে রোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং এটি অস্থিতিশীল প্রকৃতির। কোনো রকম চিকিৎসা ছাড়াই রোগের উন্নতি বা অবনতি ঘটতে পারে। শ্বেতী রোগে আক্রান্ত মোট রোগীর ৬০ শতাংশই এ ধরনের রোগী। আমাদের চিকিৎসাপদ্ধতিতে এ ধরনের রোগীর ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় এবং রোগ নিরাময়ের হার ৫০ শতাংশ। তবে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির সমন্বয়ে নিরাময়ের হার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। রোগ নিরাময়ে কয়েক বছর সময় লাগে। এ ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে স্কিন গ্রাফটিং প্রযোজ্য নয়।

৫. ইউনিভার্সালিজ শ্বেতী : এ ধরনের শ্বেতীতে আক্রান্তদের সারা শরীর (মাথা থেকে পা পর্যন্ত) এমনকি শরীরের লোম পর্যন্ত সাদা হয়ে যায়। তবে এমন রোগীর সংখ্যা খুব কম, যা মোট শ্বেতী রোগীর ২ শতাংশের বেশি হবে না। এটি স্থিতিশীল প্রকৃতির হলেও কখনো কখনো রোগীর মুখমণ্ডল, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কনুই ও হাঁটুতে রোগের কিছুটা ভালো হওয়ার আভাস দেখা যায়। এ ধরনের রোগীরা থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য অটোইমিউন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আজ পর্যন্ত এ ধরনের শ্বেতী রোগের নিরাময়ের কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারেননি।

আধুনিক চিকিৎসা : এ কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, এ রোগের চিকিৎসা কোনো একক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি সর্বজনীনভাবে কার্যকর নয়। চিকিৎসায় সাফল্য লাভের জন্য এক বা একাধিক পদ্ধতির প্রয়োগ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সেদিক থেকে বলতে গেলে আমাদের চিকিৎসাপদ্ধতি ও নীতিমালা, ফোকাল, সেগমেন্টাল অ্যাক্রোফেসিয়াল ও ভালগারিস শ্বেতী রোগে আক্রান্তদের প্রাথমিক চিকিৎসায় একটি ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এটি একটি নিরাপদ, সহজ, ব্যয় সাশ্রয়ী ও ব্যবহার অনুকূল পদ্ধতি, যাতে ৮০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ফল দেখা যায় এবং রোগ নিরাময়ের হার মোটামুটি ৭০ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসা

১. লোকাল হেলিওথেরাপি : এটি একটি অত্যধিক প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি এবং ফলাফল পরিবর্তনশীল। মিশ্রিত বা অমিশ্রিত সোরালেন ওষুধের প্রলেপ শ্বেতীর স্থানে লাগিয়ে রোদে বসে থাকতে হয় কয়েক মিনিট থেকে অনেক সময় ধরে। রোদ লাগানোর পর ওই ওষুধ না ধুয়েই ওভাবেই রাখা হয় এবং দিনের অবশিষ্ট সময় রোদে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয় না। এ ধরনের চিকিৎসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় যা রোগীর মন ভেঙে যায় ও ভয় পায়। পরে তারা চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। ফলে রোগ নিরাময় হয় না।

২. সিস্টেমিক হেলিওথেরাপি : এটিও একটি অতি প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি এবং ফলাফল পরিবর্তনশীল। প্রতিদিনই চিকিৎসা নিতে হয় এবং অনেক সময় ধরে রোদে থাকতে হয়। এই চিকিৎসায় শ্বেতী দাগ ছাড়াও সারা শরীর ওষুধের প্রভাবে আসে। এই চিকিৎসায় দিনের বাকি সময় রোদে না যাওয়ার বা এড়িয়ে চলার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় না। বরং চিকিৎসার প্রথম পর্যায়ে রোগের অযাচিত কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে।

৩. লোকাল পুভা : ঢাকায় মাত্র দুটি কেন্দ্রে এবং চিটাগাংয়ে দু-একটি কেন্দ্র রয়েছে। এটা সবার জন্য খুব সহজসাধ্য চিকিৎসাপদ্ধতি নয়। এই চিকিৎসাপদ্ধতির প্রভাব এখন পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি।

৪. সিস্টেমিক পুভা : ঢাকায় মাত্র দুটি কেন্দ্রে ও চিটাগাংয়ে দু-একটি কেন্দ্রে এ ধরনের চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। সব ধরনের রোগী অর্থাৎ সবার জন্য এই চিকিৎসা সুবিধা সহজলভ্য নয়। এই পদ্ধতি খুব ব্যাপকভাবে প্রয়োগও হয় না। এই পদ্ধতির প্রায়োগিক ফলাফল এখনো জানা যায়নি।

৫. টপিক্যাল স্টেরয়েড : এটি একটি অতি প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি। এটি এককভাবে বা একাধিক থেরাপির অংশ হিসেবে এটি চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয়। প্রতিদিন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এই চিকিৎসা নিতে হয় এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। ফলাফল পরিবর্তনশীল এবং ধারাবাহিকতাহীন।

৬. সিস্টেমিক স্টেরয়েড : সম্মিলিত থেরাপির অংশ হিসেবে এই চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। সাধারণত অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য দৈনিক একবার (ট্যাবলেট) বা মাসে একবার (ইনজেকশন) এই চিকিৎসা নিতে হয়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। ফলাফল পরিবর্তনশীল ও ধারাবাহিকতাহীন।

৭. অন্যান্য পদ্ধতি :

* এসিটিএইচ * প্লাসেন্টাল এক্সট্রাক্ট

* লেভামিসল * লবণ মিশ্রিত পানিতে গোসল

* কোলটার

* ক্ষতিকর বস্তু (রাসায়নিক/গাছগাছড়া) ব্যবহার

এসব চিকিৎসাপদ্ধতি আজকাল খুব কমই ব্যবহূত হয়। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ এ ধরনের চিকিৎসায় সাফল্য পাওয়ার দাবি করলেও সার্বিকভাবে এর কার্যকারিতা এখনো জানা যায়নি।

৮. ভিটামিন : কেবল রিবোফ্লেভিন বা ভিটামিন বি কমপ্লেক্স অথবা সম্মিলিত থেরাপির একটি উপাদান হিসেবে এই ওষুধ ব্যবহার হয়। এ ধরনের চিকিৎসার ফল বা সাফল্য তেমন উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এই চিকিৎসায় ভিটামিন সি ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল এবং খাবার রোগীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে।

সোনালীনিউজ/আরজে

Wordbridge School
Link copied!