• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
ফিল্ম রিভিউ ‘উমা’

সব বাবার হৃদয়-হিমালয় গলে যাওয়ার কাহিনি ‘উমা’ (ভিডিও)


শর্মিলা মাইতি, কলকাতা জুন ৩, ২০১৮, ০৪:৩১ পিএম
সব বাবার হৃদয়-হিমালয় গলে যাওয়ার কাহিনি ‘উমা’ (ভিডিও)

উমা পোস্টার

ঢাকা: বাবাই প্রথম পুরুষ যাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রথম পাঠ নেয় মেয়েরা। বাবাই শেষ পুরুষ, যাঁর কোলে মাথা রেখে এ জীবনের সব গোপন দুঃখ উজাড় করে দিতে পারে মেয়েরা। বাপ-মেয়ের সম্পর্কটা কোনও বিশেষ কোনও থিয়োরিতে বাঁধা পড়ে না। মনে হয় না পড়ে বলে। যদি কোনও ‘বাদ’ হিসেবে ধরাও হয়, তার গভীরতার কোনও পরিসীমা নেই। বাবারা কখনও সংহত হিমাদ্রী, কখনও অপারবিস্তৃত মহীরুহ, বটগাছের মতো নীরব আড়াল করে রাখেন সন্তানকে। হয়ত সারাজীবন। 

তবু বাংলা সিনেমায় 'মা' যতটা সেলিব্রেটেড, মা ও সন্তানের সম্পর্ক যতটা বিক্রয়যোগ্যতা ও মার্কশিট আদায় করতে পেরেছে, বাবারা তার সিকিও পারেনি। সৃজিতের ছবিতে উমা কেন্দ্র নয়, ভরকেন্দ্র। কেন্দ্রীয় চরিত্র বাবা হিমাদ্রী, এবং অন্যান্য বাবারা। এবং সবার কাছে শেষ সুযোগ, পিতৃত্ব প্রমাণের। প্রমাণ করা যে, বাবারাও পারেন!

উমার বাবা হিমাদ্রীর কাছে শেষ সুযোগ ছিল, নিজের সবটুকু দিয়ে একমাত্র মেয়ের ইচ্ছেপূরণ। যে মেয়ের জীবন ফুরোতে বাকি আর কয়টি দিন। সব সম্পত্তি বাজি রেখে প্রাণের শহর কলকাতায় ‘নকল’ দুর্গাপুজো। শেষযাত্রার আগে মেয়ে দেখতে চেয়েছে যে!

পুরাণকে প্রতীকী হিসেবে ব্যবহার করার নমুনা ভারতীয় ছবিতে বিরল নয়। এছবির প্লটটা এমনই যে, পরিচালকও চরিত্রের নামকরণের ক্ষেত্রে দুর্গতিনাশিনীর শরণাপন্ন হয়েছেন। উমার বাবা হিমাদ্রী, মা মেনকা। উমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে বাবা হিমাদ্রী কলকাতা শহর জুড়ে দুর্গাপুজো করতে চান এপ্রিল মাসে। আভাসে আসে বাসন্তীপুজোর কথা। পুরাণমতে এই সময়েই তো আসল দুর্গাপূজা। কিন্তু যুগের পর যুগ আমরা রামচন্দ্রের অকালবোধন-কেই মান্যতা দিয়ে আসছি। অতিকষ্টে যে পরিচালক অবশেষে এই 'নকল' দুর্গাপুজো 'সিনেমার মতো' সাজিয়ে-গুছিয়ে করতে রাজি হলেন, তিনি ব্রহ্মানন্দ। 

তাঁর সহকারীদের নামের মধ্যেও কোনও না কোনওভাবে জড়িয়ে পুরাণের অনুষঙ্গ। আবার, উমার কলকাতার কাকুর নাম বরুণ, (তিনি আবার বৃষ্টি পড়া-না-পড়ার ব্যাপারটা 'নিয়ন্ত্রণ' করতে পারেন)। নেগেটিভ চরিত্রে অনির্বাণের নাম মহীতোষ (মিল মহিষাসুরের সঙ্গে) । পরিচালক নিজে যে চরিত্রটি বেছে নিয়েছেন, তার নাম ইন্দ্র। কিন্তু, সবক্ষেত্রে পুরাণই মুখ্য নয়।

একটা আলগা কাঠামো মাত্র। ভিতরের হদপিণ্ডে যে ধুকপুক করছে বাবারাই। কেউ পরাজিত। কেউ উপেক্ষিত। কেউ নিঃস্ব। এদের সকলকে এক ফ্রেমে আনল উমা। প্রতি পুরুষের মধ্যে জাগিয়ে দিল পিতৃসত্তা। সে বাবা হোক বা না হোক! অভিনেতা অঞ্জন দত্ত। একসময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ পরিচালক বহ্মানন্দ আজ নিঃস্ব, একাকী। এ ছবিতে তিনিই রচনা করছেন নকল ব্রহ্মাণ্ড। 

এপ্রিল মাসে আনন্দের শহরে সাজানো দুর্গাপুজো। এক হেরে যাওয়া বাবা। ডিভোর্সের পর সন্তানকে রাখতে পারেননি নিজের কাছে। সেই অপরাধবোধ, বেদনাই উমার ইচ্ছেপূরণের দিকে ঠেলে দেয় এই 'নির্বাসিত' পরিচালককে। (উল্লেখ্য, চূর্ণী গাঙ্গুলি তাঁর নিজের ছবির পোস্টার ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন অন্য পরিচালকের নাম দিয়ে। ক'জন করেন!) ভোলার নয় অঞ্জন দত্তের অভিনয়। 

পরিচালক সৃজিতের থেকে অনায়াসে ট্রোফি নিয়ে চলে যাবেন। যিশুর অভিনয়ে, যিশুর চোখের জলে, আর্তিতে, রাগে সব দর্শকই তাঁদের বাবাকে খুঁজে পাবেন। এই ছবিতে অভিনয়ের চেয়ে অনেক উঁচু আবেগের চুড়োয় নিজেকে বসিয়ে ফেললেন, যা তিনি নিজেও ভুলতে পারবেন না। কৃতিত্ব একান্ত নিজেরই। 

তেমনি আর এক পিতৃত্বের সন্ধান বাবুল সুপ্রিয়র চরিত্রে। ভাড়াটে গুণ্ডারও বন্দুককে অবশ করে দেয় উমার কাতর প্রার্থনা। আর এক অন্য বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায় শেষ শয্যায়, মনোজ মিত্রের চরিত্রে। ছেঁড়াছেঁড়া সমৃতি জড়ো করে তিনি যা বলেন পুত্রসম ব্রহ্মানন্দকে, সেটাই পরোক্ষে হয়ে ওঠে কাহিনির ইন্ধন। 

'নকল' মা হিসেবে শ্রাবন্তীর অভিনয় মুগ্ধ করে। মেনকা হিসেবে সায়ন্তিকাও। তবে মায়েদের চেয়েও বেশি এটা বাবাদের ছবি বলে শেষ পাতে পায়েস তাঁরাই পেয়েছেন! মোট কথা, উমার কাহিনি অনবরত পুরাণ ছাড়িয়ে বাস্তবের, সমতলের গল্প বলার চেষ্টা করে। সারার চোখের গভীর আবেদন, নিষ্পাপ মধু-মাখা মুখ আর যিশুর কঠিন হাতে আসন্ন মৃত্যুর মুখে পাথরের দেওয়াল তুলে প্রাণপণ ঠেকানোর চেষ্টা, এই মিলমিশ যে-আবেগের ট্রেন তৈরি করেছে, তাতেই উঠে পড়ছেন সবাই। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। চলছে অনুপমের গান, মেঘ-রোদ্দুরের মতো সঙ্গী গয়ে। হোক সবই মিথ্যে, সবই তো এক ছোট্ট মেয়ের জন্য। এই আবেগ ছড়াতে ছড়াতে একসময়ে হয়ে ওঠে কলকাতাবাসীর মূলমন্ত্র। কীভাবে, সেটাই দেখবেন ছবিতে।

দেখবেন, আজও কীভাবে সিনেমা আমাদের আবেগের প্রলেপ লাগানো, নকল দুনিয়াকে আসলের মতো করে দেখায়। সেই সব মানুষগুলোকে, যাঁরা নিরন্তর পরিশ্রম করে চলেন এই মিথ্যেকে সত্যির মতো করে তুলে ধরতে। আমাদের স্বপ্নের কারখানা গড়েতুলতে। শহরজুড়ে তোড়জোড়ের মধ্যে সেই চাপা শব্দ গুমরে চলে। 

গল্পের চাহিদা আর যোগানে ফাঁকফোঁকর আছে। উমার স্বপ্নপূরণ করতে গিয়ে, গল্প কখনও কখনও বাস্তব থেকে উঁচুতে, আরও উঁচুতে উঠে গেছেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, ছোটদের দুনিয়ায় সত্যি যে কোথা থেকে শুরু হয় আর স্বপ্ন কোথা থেকে শুরু হয়, কেউ বলতে পারে না! আর এখানে তো এতজন বড়-রা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন ছোটদের স্বপ্নটা আঁকতে, ওটুকু লাইসেন্স দেওয়া যেতেই পারে। 

সৃজিত চেষ্টা করেছেন সব ধাপেই লজিক দিয়ে ‘এরর ফ্রি’ করতে। ছবির শেষে সেই বাস্তবের নায়ক ইভানের ছবিগুলো মন টানে, ভিজিয়ে দেয়। সুদূর বিদেশের একটি জীবন, কেমনভাবে সারা বিশ্বের হৃদয়ে দাগ দিয়ে গেল, উমা ছবির সূত্র তো সেখান থেকেই। সবার শেষে পরিচালকও জানেন, তিনি সফল হোন বা পরাজিত...হলে একটিমাত্র দর্শক থাকলেও গল্প বলার সুযোগটা হাতছাড়া করলে চলবে না! 

কারণ, সেটাই বাঁচিয়ে রাখবে। সৃজিতের ছবি উমার প্রযোজনা করছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। উমার গল্প সত্য ঘটনা অবলম্বনে। কানাডার ছেলে ইভান কঠিন রোগে আক্রান্ত। তার ক্রিসমাসের সেলিব্রেশন দেখে যাওয়ার ইচ্ছা পূরণ করতে তাঁর বাবা ক্রিসমাসের আগেই উৎসবের সেলিব্রেশনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ২০১৫র সেই ঘটনাকে বাংলার প্রেক্ষাপটে ফেলে তাঁর সিনেমা 'উমা'য় রূপ দিয়েছেন পরিচালক সৃজিত। 

ছবির মুখ্য চরিত্রে রয়েছে যিশু সেনগুপ্ত ও নীলাঞ্জনা সেনগুপ্তের বড় মেয়ে ‘সারা’। ছবির নামভূমিকায় সে-ই। বিভিন্ন চরিত্রে রয়েছেন যিশু সেনগুপ্ত, সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, নীল মুখোপাধ্যায়, গার্গী রায়চৌধুরী, অভিজিৎ গুহ, অঞ্জন দত্ত, সায়ন্তনী গুহঠাকুরতা, পারমিতা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ১লা জুন কলকাতায় মুক্তি পেয়েছে ‘উমা’।


ট্রেলার দেখুন-

সোনালীনিউজ/বিএইচ

Wordbridge School
Link copied!