• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সবজি পচছে ক্ষেতে-বাজারে খাচ্ছে গরু-ছাগল


নিজস্ব প্রতিবেদক মার্চ ৩১, ২০২০, ১২:১৫ এএম
সবজি পচছে ক্ষেতে-বাজারে খাচ্ছে গরু-ছাগল

ঢাকা : বেগুনের কেজি দেড় টাকা আর শসা দুই! এর বেশি দাম বলছেই না কোনো পাইকার। অবশেষে ক্ষোভে-দুঃখে বিক্রি না করে সে সবজি গরু-ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন কৃষক লিয়াকত মিয়া।

রোববার (২৯ মার্চ) এমনটাই দেখা গেছে জয়পুরহাট জেলার অন্যতম পাইকারি কাঁচাপণ্যের হাট আক্কেলপুরে।

শুধু এখানেই নয়, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গে সবজিসহ কাঁচাপণ্যের সবচেয়ে বড় মোকাম মহাস্থানগড়সহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার অধিকাংশ হাটেই এমন অবস্থা। আক্কেলপুরসহ ওই এলাকার আশপাশে কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, চাহিদা না থাকায় ওই সব হাটে সবজির ক্রেতা নেই, পাইকারও নেই। যে পরিমাণ সবজি প্রতিদিন হাটে আসছে তার চেয়ে চাহিদা কয়েক গুণ কম। ফলে বিভিন্ন হাটে সবজি বিক্রি না করতে পেরে ফিরে যাচ্ছেন কৃষকরা। পরে সেগুলো হয় বাড়িতে পচছে; না হয় গরু-ছাগল খাচ্ছে।

দেশজুড়ে করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবে শুরু হয়েছে এমন অবস্থা। মাঠজুড়ে যখন গ্রীষ্মকালীন সবজি ভরপুর ঠিক সেই সময় ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে একপ্রকার লকডাউন হয়ে পড়েছে দেশ। রাস্তায় পণ্য পরিবহন বন্ধ না থাকলেও কার্যত বাজারে সবজির চাহিদা নেই। অন্যদিকে করোনাঝুঁকির সঙ্গে বেড়ে চলেছে পণ্যবাহী ট্রাকভাড়া। ফলে কেনাবেচা বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে আছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। এতে দেশে রেকর্ড পরিমাণ সবজি উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোতে মাথায় হাত উঠেছে কৃষকের। তাদের কষ্টে ফলানো ক্ষেতের সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে। দাম না থাকায় সবজি তোলায় আগ্রহ নেই কৃষকের। সীমাহীন লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।

গত কয়েক দিনের স্থবিরতায় বিপুল পরিমাণ সবজি নষ্ট হয়েছে মোকামে ও মাঠে। গত ২৩ থেকে গতকাল ২৯ মার্চ—এই এক সপ্তাহে শুধু জয়পুরহাট থেকে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ঢাকায় সবজিপণ্য সরবরাহ কমেছে প্রায় দেড়শ ট্রাক। এর ফলে প্রায় কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন সবজিচাষি ও ব্যবসায়ীরা।

জেলার সবজিপণ্য পরিবহন সমিতি জানায়, এক সপ্তাহে প্রায় ২ হাজার টন সবজি ঢাকায় পাঠানো যায়নি। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন জয়পুরহাটের বিভিন্ন হাটবাজার থেকে ৫০-৬০টি ট্রাকবোঝাই সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। সেখানে গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন ট্রাক গেছে মাত্র ১০ থেকে ২০টি।

জেলার আক্কেলপুরের ওই বাজারে নওগাঁ জেলার অনেক কৃষকও সবজি বিক্রির জন্য আসেন। সেখানে ভান্ডারপুরের কৃষক নজু মিয়া বলেন, ‘এবার দেড় বিঘা জমিতে শসা চাষ করেছি। শুরুতে প্রতি কেজি গড়ে ১৫ টাকা করে বিক্রি করেছি। কিন্তু করোনা ভাইরাসে সারা দেশ অচল হওয়ার পরে দাম নেমেছে মাত্র দুই টাকায়। এতে বিঘাপ্রতি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা লোকসান হবে।’

নজু মিয়া আরো বলেন, ‘ভেবেছিলাম সবজি বিক্রি করে করোনা পরিস্থিতির এ সময় কিছু বাজার-সদাই করব। তবে সেটা হচ্ছে না। এমন চললে বউ-বাচ্চা নিয়ে অনাহারে থাকতে হবে।’

একই বাজারে অরেক কৃষক সুমন বেগুন বিক্রি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘হাটে বেপারি নাই, বেগুন কিনবার লোক নাই। এক-দেড় টাকা দরে বিক্রি করছি। এ টাকায় ভ্যান ভাড়াও ওঠে না। আর বিঘাখানেক জমিতে বেগুন আছে। হাটে না এনে গরু-ছাগলকে খাওয়াব।’

সবজির পাইকারি মোকামগুলোর চার-পাঁচজন আড়তদার জানান, বাজারে ব্যাপক সবজি রয়েছে। তবে রাজধানীসহ বিভিন্ন বড় শহরে লোকজন না থাকায় চাহিদা নেই। অন্যদিকে ট্রাকভাড়া কিছুটা বেড়েছে। অথচ দাম দিয়ে কেনা সবজি বিক্রি করা যাচ্ছে না। তাই তারা কম দামে কিনছেন অথাবা বসে বসে দিন কাটাচ্ছেন।

অন্যদিকে রাজধানী পর্যন্ত কাঁচাপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা ঠিক থাকলেও চাহিদা একদমই তলানিতে ঠেকেছে। কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি এটিএম ফারুক বলেন, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন এ বাজারে অন্তত তিনশ ট্রাক সবজি কেনাবেচা হয়। কিন্তু গতকাল (শনিবার) রাতে এখানে একশ ট্রাক সবজিরও  কাটতি ছিল না। পাইকারি ব্যবসায়ী যারা বস্তায় বস্তায় সবজি কিনত তারা কয়েক কেজি করে সবজি কিনে পাড়া-মহল্লায় খুচরায় বিক্রি করছেন। তারাও দিন পার করছেন কোনোমতে। এ খাতে নিয়োজিত ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে এ অবস্থার কারণে।

এদিকে বগুড়া মহাস্থানগড়ের ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা জানিয়েছেন, আলুসহ প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ ট্রাক সবজি ওই এলাকা থেকে পাঠানো হতো ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। কিন্তু ২৩ মার্চের পর থেকে তা অর্ধেকে নেমেছে। এখনো দিন দিন আরও কমছে। ওই এলাকায় সবজি ব্যবসা অচল হয়ে পড়েছে। ফলে মাঠে থাকা আলুসহ গ্রীষ্মকালীন অন্যান্য সবজি পচনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিভিন্ন আড়ত থেকে জানা যায়, গতকাল কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৬ টাকা, বাঁধাকপি প্রতি পিস ১ টাকা, করলা প্রতি কেজি ২০ টাকা, গাজর ৬ টাকা, টমেটো ৫ টাকা,  ঢ্যাঁড়শ ২৫ টাকা, পটোল ৩০ টাকা, লাউ প্রতিটি ১০ থেকে ১৫ টাকা ও লালশাক ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

এদিকে করোনার প্রভাবে পরিবহন ভাড়াও বেড়েছে জানিয়ে মহাস্থানগড় হাটের কাঁচামাল আড়ত সমিতির সদস্য জাহিদুল ইসলাম বলেন, আগে এখান থেকে সবজি ঢাকায় পাঠাতে ১৫ হাজার টাকা ভাড়া লাগত। এখন তা বেড়ে ১৮ হাজার হয়েছে।

তিনি আরো জানান, প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রাম মোকামে সবজি যেত ৫০০ থেকে ৭০০ টন। সব মিলিয়ে এখন বিচ্ছিন্নভাবে ৮০ থেকে ১০০ টন আলু ও ৫০ থেকে ১০০ টন অন্যান্য সবজি বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এতে প্রতিদিন তাদের প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!