• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সবাই যখন ভিডিও করছিল, মকলিস তখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত ছিল


মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানুয়ারি ২৯, ২০২০, ১০:৩২ পিএম
সবাই যখন ভিডিও করছিল, মকলিস তখন আগুন নেভাতে ব্যস্ত ছিল

মৌলভীবাজার: হটাৎ ভয়াবহ আগুন। নিমিষেই শেষ ৫টি তাজা প্রাণ। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট ২ ঘণ্টা কাজ করে। তাদের সঙ্গে কাজ করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। যদিও বড় একটি অংশ ফেসবুক লাইভ আর ছবি তুলতে গিয়ে বারবার ভিড় করে উদ্ধার কাজ ব্যাহত করেছে তবে এর মধ্যে সবার নজর কেড়েছেন এক যুবক। তার নাম মকলিস মিয়া।

তিনি পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক। অনেকেই যখন নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন নিজের সিএনজি অটোরিকশাটি রেখে আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এ যুবক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফায়ার সার্ভিস টিমের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কাজ করেছেন তিনি।

মকলিস মিয়ার বাড়ি কমলগঞ্জের কালেঙ্গা এলাকায়। তিনি মৌলভীবাজার শহরের একজন সিএনজি চালক। ঘটনার সময় তিনি সদর উপজেলার কামালপুরে যাত্রী নামিয়ে আরও কয়েকজন যাত্রীকে নিয়ে শহরের ভেতর দিয়ে কুলাউড়া উপজেলার যাবার জন্য রওয়ানা দেন। কিন্তু কুসুমবাগ পয়েন্টে আসার পর তার গাড়ি আটকে দেয় ট্রাফিক পুলিশ।

এ সময় পুলিশ বলে এ রোডে আগুন লেগেছে রাস্তা বন্ধ। এ কথা শুনে ডান দিকে ২০০ মিটার দূরে হাটবাজারের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেন এবং যাত্রীদের বলেন আমি যেতে পারবোনা আপনারা অন্য একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে চলে যান।

যাত্রী নামিয়ে হাটবাজারের শপের সামনে অরক্ষিত অবস্থায় সিএনজি অটোরিকশা রেখে দৌড়ে চলে আসেন আগুন লাগার স্থান শহরে সেন্ট্রাল রোডের পিংকি সুস্টোরের সামনে। এসে যোগ দেন আগুন নেভানোর কাছে।

এ বিষয়ে মকলিস জানান, আমি দৌড়ে এসে দেখি ভয়াবহ আগুন। আমি মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা চালু করে দৌড়ে আসি। এসে দেখি শতশত মানুষ ভিডিও করছে কিন্তু কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না তেমন। আশেপাশের কিছু মানুষ ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করছে। এত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এবং আগুনের ভয়াবহতা দেখে আমি মোবাইল বন্ধ করে নেমে পড়ি আগুন নেভানোর কাজে। প্রথমে পাশের বিল্ডিং থেকে চেষ্টা করেছি কুড়াল দিয়ে টিন কাটতে। টিন কেটে ভেতরে পানি ঢুকাতে ফায়ার সার্ভিসকে সাহায্য করি। এরই মধ্যে বালু চলে আসলে বালু দিয়ে গ্যাসের রাইজার থেকে আগুনের উৎস বন্ধ করতে বালু দেই।

ফায়ার সার্ভিসের প্রথম দলের সঙ্গে পাইপ নিয়ে ভেতর পর্যন্ত যাই। পানির পাইপ টানতে টানতে কীভাবে চলে গেছে ২ ঘণ্টা তা জানি না। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আগুন নেভানোর পর যখন ক্লান্ত হয়ে বসে ছিলাম তখন বুঝতে পেরেছি আমি কি কি করেছি এর আগে কীভাবে কি করেছি বুঝে উঠতে পারিনি।

তবে শত শত মানুষ যেভাবে দাঁড়িয়ে শুধু ভিডিও করছিল তাতে কষ্ট লেগেছে। কোনো মানুষের বিপদে সবার ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত। তবে আমি কষ্ট করেছি এ নিয়ে কিছু বলার নেই যদি সব মানুষ বেঁচে থাকত এবং ৫ জন মারা না যেত।

ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থাকা ব্যবসায়ী নেতা সুমন আহমদ বলেন, নিজের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে একজন সিএনজি চালক তার গাড়ি ফেলে রেখে যেভাবে আগুন নেভানোর কাছে ফায়ার সার্ভিসকে সহযোগিতা করেছে তা খুব কম দেখা যায়। গতকালের ঘটনার সময় অনেকেই ব্যস্ত ছিলেন মোবাইলের ছবি এবং ভিডিওধারণ নিয়ে। পুলিশকে বারবার অতি উৎসাহী মানুষকে সরাতে কাজ করতে হয়েছে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) পরিমল দাস। তিনি জানান, কোনো কিছু ঘটলে সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ছবি তোলা এবং ফেসবুকে লাইভ করার প্রতিযোগিতা শুরু হয় তা আমাদের দেখিয়ে দেয় আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র। এমন একটি সময়ে একজন সাধারণ সিএনজি ড্রাইভার যেভাবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

তিনি আরও জানান, অনেক সাধারণ মানুষ সাহায্য করেছে এবং ফায়ার সার্ভিসের কঠোর পরিশ্রমের কারণে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসে।

মৌলভীবাজার ফায়ার সার্ভিসে উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ হারুন পাশা বলেন, আমরা সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করছি। কোনো একটি ঘটনা ঘটলে ছবি বা ভিডিও করতে গিয়ে কিছু অতি উৎসাহি মানুষ আমাদের কাজে বিঘ্ন ঘটায়। তবে এর মধ্য কিছু সাধারণ মানুষ মাঝে মাঝে পাই যারা সত্যি অসাধারণ। তারা কোনো দায়িত্বে নয় নিজের বিবেকের তাড়নায় জীবন বাজি রেখে কাজ করেন আমাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে। এরা প্রশংসার দাবিদার।

তিনি বলেন, গতকালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে ছেলেটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করল তিনি একজন সিএনজিচালক। কিন্তু তার সামাজিক দায়িত্ববোধ অবাক করার মতো।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে শহরের সাইফুর রহমান রোডের পিংকি সুস্টোরে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। এ সময় দোকানের উপরের বাসায় সবাই আটকা পড়ে।

আটকা পড়াদের মধ্যে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

নিহতরা হলেন, পিংকি সুস্টোরের মালিক সুভাষ রায় (৬৫), মেয়ে প্রিয়া রায় (১৯), সুভাষ রায়ের ভাইয়ের স্ত্রী দিপ্তী রায় (৪৮), সুভাষ রায়ের শ্যালকের বউ দীপা রায় (৩৫) ও দীপা রায়ের মেয়ে বৈশাখী রায় (৩)।

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!