• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তানকে উদার হতে হবে


আহমেদ তেপান্তর সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০, ০৬:১৪ পিএম
সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তানকে উদার হতে হবে

ঢাকা : বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রায় অর্ধশত বছর হতে চললেও পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। বরং গত এক দশকে আরও শীতল হয়েছে। তবে সম্পর্ক উন্নয়ন হবে না, এ ধারণাও ঠিক নয়। ইসলামাবাদ উদার হলে সেটি সম্ভব। আর তাই সম্প্রতি দেশটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ফোন করা বেশ গুরুত্ব বহন করে। এ ক্ষেত্রে ঢাকাকে সতর্ক দেখা গেলেও উদ্বিগ্ন দিল্লি। নানা ইস্যুতেই দেশটি ঢাকাকে বন্ধুত্বের পুরোনো কাসুন্দি মনে করিয়ে দিচ্ছে।

যদিও বিশ্লষকরা বলছেন সম্পর্কের উন্নয়নে বিস্তর বাধা, একই সঙ্গে ‘প্রয়োজন নেই’ কথাটিও উচ্চারিত হচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। ১৯৭১-এর ক্ষতের দিক চিন্তা করলে বিশ্লেষকদের ধারণাকেই অকাট্য মনে হবে। এর মানে এই নয় সম্পর্ক উন্নয়ন হতে পারে না। সম্পর্কের সেই উন্নয়নের জায়গায় পারস্পরিক সম্মান ও বিগত সময়ের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার কাজটি করতে ইসলামাবাদকেই উদ্যোগী হতে হবে, এমনটা মনে করেন অনেক বিশ্লেষকই। ঢাকা যদি তাদের সে পদক্ষেপে তৃপ্ত হয় তবে অবশ্যই ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোতে পারে।

ভুললে চলবে না যে, তৎকালীন সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ২০০৬ সালে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের লাশ দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ঢাকায় ফিরেছিল। এরপর সেই উষ্ণ সম্পর্কটা শীতল হলো মহাজোট সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে ইসলামাবাদের হস্তক্ষেপে। সরকার যখন কৃত অপরাধের জন্য ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করল ইসলামাবাদ তখন নানাভাবে সে প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেশটির কূটনৈতিক মহল বেমালুম ভুলে গেছে স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে যে জাতি একটি সার্বভৌম অস্তিত্ব নিয়ে অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে তার আভ্যন্তরীণ ইস্যুতে মৌখিক প্রতিক্রিয়া অস্তিত্বে হুমকির শামিল। ইসলামাবাদ এ কাজটি করতে বিশ্ব জনমতও গঠনে চেষ্টা করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়াকে বানচালে তাদের এই চক্রান্তকে এ প্রজন্ম ভালোভাবে নেয়নি। যে কারণে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব বেশ তুঙ্গে। এ প্রক্রিয়াটিতে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকাও ঢাকা লক্ষ্য করেছে। স্বভাবতই একধরনের কূটনৈতিক বিজয় দিল্লি অর্জন করেছে।

তবে অতিসম্প্রতি দিল্লি ৩৭০ অনুচ্ছেদ অবলুপ্ত করে। ভারত সরকারের এমন উদ্যোগকে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে ঢাকা বিবৃতি দেয়। তবে বিবৃতিতে কোথাও বাংলাদেশ মতাদর্শগত বা নীতিগতভাবে সমর্থন করছে এমনটা বলা হয়নি। এই ইস্যুতে সরকারের যাই ভাবনা থাকুক না কেন যুবসমাজের ভাবনা ভিন্ন।

ভারতীয় কলামলেখক জয়ন্ত ঘোষাল তার একটি লেখায় এটি উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘আসলে বাংলাদেশের যুবসমাজে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া কী, তা বেশ কিছুদিন ধরেই বুঝতে বা জানতে চাইছে ভারত...। বাংলাদেশের জনসমাজে বাঙালি সত্তা বা পরিচয় যেমন আছে, তেমন আছে বাঙালি মুসলমান সমাজের পরিচয়। এই সত্তাটি হলো ইসলামিক সত্তা। এই সত্তাটি কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশ গঠনের পরও ছিল। এই মুসলমান সমাজ কিন্তু কাশ্মীরের এই সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দিগ্ধচিত্ত। ইসলামের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক সুসম্পর্কের ঐতিহ্যও আছে। ঢাকা বইমেলায় গিয়ে দেখেছি একদিকে বিক্রি হয় কোরআন শরিফ, আবার অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলা সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজও বইয়ের বাজারে অপরিসীম আগ্রহ।’

ইসলামাবাদের ফোন করা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষক আফসান চৌধুরী মনে করেন “ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক কখনই উষ্ণ হবে না, অন্তত যত দিন তার প্রজন্ম বেঁচে থাকবে। বরং ‘খারাপের থেকে একটু ভালো’ হতে পারে” বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরধীদের বিচারপ্রক্রিয়ায় ইসলামাবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপকে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধান বাধা উল্লেখ করে ‘ভবিষ্যতেও সম্পর্ক দরকার নেই’ বলে মত প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি স্মৃতিকাতর হয়ে জোর দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার ওপর। এ ক্ষেত্রে দুটো বিষয় বেমালুম এড়িয়ে গেছেন অথবা ভুলে গেছেন সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের মনোভাবের কথা, একইভাবে এড়িয়ে গেলেন জাতীয় নির্বাচনে বহুল প্রচারিত ধারণা দিল্লির হস্তক্ষেপের অভিযোগ। এমনকি অতি সম্প্রতি ভারতের পত্রিকায় বাংলাদেশকে চীনের সহযোগিতাকে ‘খয়রাতি’ উল্লেখ করে যে প্রতিবেদন প্রকাশ হলো সেটির কথাও।

আফসান চৌধুরী দক্ষিণ এশিয়ায় দিল্লির সাম্প্রতিক ভাবমূর্তির কথাও ভুলে গেছেন হয়তো। এ মুহূর্তে দিল্লির সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ ছাড়া কেউ নেই। বিশ্লেষকরা স্পষ্ট করেছেন ‘বন্ধুত্বপূর্ণ মর্যাদার বদলে বড় ভাইসুুলভ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি দিল্লির প্রতি ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এ সময়ের উদাহরণ’।

প্রশ্ন  হচ্ছে, খুব কাছের প্রতিবেশী হিসেবে ‘মর্যাদা’র প্রশ্নে বাংলাদেশ কি ভারত থেকে তা পাচ্ছে? এটা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বলে দিয়েছেন- ‘আমরা যা দিয়েছি ভারত তা চিরজীবন মনে রাখবে’।

ইসলামবাদ এ বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রেখেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। ঢাকা এ ক্ষেত্রে চীন এবং ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক দৃঢ় যোগাযোগের ব্যাপারটি মাথায় রাখবে। বাণিজ্যক্ষেত্রে চীনের বিপুল ছাড়সহ সামরিক খাতে চীনের প্রভাবকেও অস্বীকার করা প্রায় অসম্ভব।

ইসলামাবাদের ফোনের পর ঢাকার প্রতি দিল্লির একধরনের গুরুত্ব দৃশ্যমান হয়েছে দেশটির পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধণ শ্রিংলার আগমনে। জার্মানভিত্তিক ডয়েচে ভ্যালে বাংলা যেটাকে শিরোনাম করেছেন ‘শ্রিংলা বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কোন্নয়নের ভ্যাকসিন’ হিসেবে।

ধর্মীয় বিষয় নিয়েও ভারত কিছুটা চাপে। ভারতের নাগরিকপুঞ্জ তালিকা নিয়ে ঢাকার রয়েছে অপ্রকাশ্য ক্ষোভ। একই সঙ্গে বাবরী মসজিদের ঐতিহাসিক রায়কে ঘিরে এদেশের মুসলিম সংখ্যাগুরুদের চাপা ক্ষোভ। প্রতিবেশী দেশ যখন এমন ঘটনায় উত্তপ্ত, তখন ইসলামাবাদ সনাতন ধর্মীয়দের চার শতাধিক মন্দির সংস্কারের ঘোষণা দেশটির ভাবমূতি উজ্জ্বল করেছে। কূটনৈতিকভাবেও এর প্রভাব স্পষ্ট।

ঢাকা-দিল্লির বন্ধুত্ব ইস্পাতসম। আবার উল্টোটিও দেখছি। তা না হলে নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা কেন ভারতকে পিঠ দেখাবে?

এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনালাপে ইমরান খান বলেন, ‘পারস্পরিক বিশ্বাস, পারস্পরিক সম্মান এবং সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক গভীর করতে পাকিস্তান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। মর্যাদার প্রশ্নে এমন শব্দগুলোকে খাটো করে দেখার সুযোগ কম।

ঢাকার সঙ্গে ইসলামাবাদের অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর ন্যায্য হিস্যা, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণহানির মতো বড় ঘটনাকে স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা সম্পর্ক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হতে পারে বলে এ প্রজন্ম মনে করছে। এটাও সত্য শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে ইসলামাবাদের চেয়ে ঢাকার অর্থনীতি টেকসই এবং মজবুত। তারপরও সম্পর্ক উন্নয়নে ঢাকা চীন প্রভাববলয়ের ইসলামাবাদের ফোনকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি হয়তো ভাববে।

অনেক অমীমাংসিত ইস্যু থাকার পরও দুদেশের এ প্রজন্মের জনগণ ‘সতর্ক’ এবং ‘মর্যাদাকে’ সামনে আনছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইমরান খানের মধ্যে ফোনালাপকে দক্ষিণ এশীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে করাচির লেখক ও সংগঠক কিরণ সিদ্দিকী বলেন ‘দুদেশের সম্পর্কোন্নয়ন সময়ের চাহিদা এবং জরুরি।  বলেন, ইমরান খানের ফোনালাপ পাকিস্তানি জনগণের আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু বন্ধুত্ব কখনো একপক্ষীয় হয় না, হলেও সেটা বেশি দিন টেকসই হয় না। ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্র। বাংলাদেশিদের জন্য পাকিস্তানের সাধারণের আবেগ ঠিক আগের মতোই।

‘১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েও শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করাটাও ছিল ঐতিহাসিক ভুল। ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল বাঙালিরা।’

কিরণ মুক্তিযুদ্ধকে ‘ঐতিহাসিক’ তবে ‘অতীত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বলেন, একটি রাষ্ট্র কেবল আবেগ দিয়ে চলে না। দক্ষিণ এশিয়ার যে অবস্থা, তাতে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান সুসংহত করতেই দুদেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক দরকার। অতীতের ভুলগুলোকে গ্রহণযোগ্য অবস্থান থেকে স্বীকার করে সম্পর্ক উন্নয়নে ঢাকার সঙ্গে কাজ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে ঢাকার আগ্রহকেও ইসলামাবাদ পর্যবেক্ষণ করবে নিশ্চয়ই।

বাংলাদেশের লেখক ইমরান রহমান বলছেন, অতীতে যে শোষণ-বঞ্চনা শিকার বাংলাদেশের জনগণ হয়েছে এগুলো প্রতিনিয়ত অস্বীকার, আভ্যন্তরীণ ইস্যুতে ক্রমাগত হস্তক্ষেপ, মহাজির সমস্যা এ প্রজন্মকেও অসহিষ্ণু করছে। ইসলামাবাদকে সম্পর্ক উন্নয়নে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি কতটা মিলিটারি প্রভাব থেকে বেরুতে পারেন সেটা সময় বলে দেবে। তবে এটা সত্য, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে বাংলাদেশর গুরুত্বকে আরও বিস্তার করা সম্ভব দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে। ভারতকে পাশ কাটিয়ে সেটা সম্ভব নয়, এ সত্যকেও কূটনীতিকদের মাথায় রাখতে হবে।

তিনি বলেন, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ মর্যাদা প্রাপ্য; এ সত্য উপলব্ধি করে ইমরান খানকে এগিয়ে আসতে হবে। যে অভিমান এ প্রজন্মের হূদয়ে প্রোথিত তা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ইসলামাবাদকে নিতে হবে।

নানা কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের অবস্থান সুসংহত নয়, যে কারণে বাংলাদেশের ভারতনির্ভরতা অতীত থেকে অনেক বেশি। এক চীন-আফগানিস্তানকে বগলদাবা করে ভারত বিরোধিতা পাকিস্তানের জন্য হবে বোকামি। তেমনি চীন-তুরস্ক-ইরান প্রভাববলয়ের ইসলামবাদের কূটনৈতিক তৎপরতাকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন, বৈদেশিক মর্যাদা বৃদ্ধির প্রশ্নে ঢাকাকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমনি অতীত ঘটনাবহুল ইতিহাসের যৌক্তিক দাবিকেও ইসলামাবাদের অস্বীকারের সুযোগ নেই।

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!