• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব


নাজমুল হক আগস্ট ২৪, ২০১৯, ০২:৪৫ পিএম
সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব

ঢাকা : ঢাকা থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ এখন সারা দেশে ছড়িয়েছে। শেষ ১০ দিনে হাজার হাজার গরু ব্যবসায়ী গ্রাম থেকে কোরবানির গরু বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে হাটের খোলামেলা পরিবেশে থেকে গেছেন। হাটের পরিবেশটি মশা কামড়ানোর জন্য খুবই অনুকূল।

এখন কথা হচ্ছে, কতজন গরু ব্যবসায়ী ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন তা এখন দেখার বিষয়। মহামারীর মতোই আতঙ্ক তৈরি করেছে ডেঙ্গু। কিন্তু আতঙ্কিত না হয়ে একে মোকাবেলা করতে হবে আমাদেরই। ডেঙ্গুর মতো আরো কিছু জটিল পরিস্থিতির মোকাবেলায় আমরা কিন্তু ততটা আতঙ্কিত নই, যতটা আতঙ্কিত ডেঙ্গুতে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর ১২ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় অর্থাৎ প্রতিদিন পানিতে ডুবে মারা যায় ৩২ শিশু। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ ফিলালথ্রপিসের অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) যৌথ গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা জরিপ (২০১৬) অনুসারে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ২৪ হাজার ১৪৭ জন অর্থাৎ প্রতিদিন সড়কে মৃতের সংখ্যা ৬৬ জনেরও বেশি। কিন্তু প্রতিদিনের এত সংখ্যক মৃত্যুতে আমরা মোটেই আতঙ্কিত নই। সম্ভবত এই মৃত্যুগুলো আমাদের কাছে প্রভাবহীন অথবা আমরা এগুলোর ব্যর্থতা মেনে নিয়েছি।

অথচ ডেঙ্গুতে প্রতিদিন প্রায় ৩ জনের মৃত্যুতে আমরা ১৭ কোটি মানুষ আতঙ্কিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি, তাই এ বছর মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।

কলকাতার মতো সারা বছরই যদি মশক নিধন না করা যায়, তাহলে এবার যারা আক্রান্ত হয়েছে আগামীতে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে। সর্বোপরি সচেতনতা বৃদ্ধি না করলে সামনের বছর মৃতের সংখ্যা আরো বাড়বে। জুন-জুলাই মাসে মশা হঠাৎ অতিথি পাখির মতো উড়ে আসে না; বরং গত বছরের ডেঙ্গু মশার ডিমগুলো অর্থাৎ এদের প্রজনন সক্ষম লার্ভাগুলো আমাদের পরিবেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, শুষ্ক পরিবেশে এগুলো ৬ মাস জীবিত থাকে।

বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে প্রজনন হয়ে পর্যায়ক্রমে মশার বিভিন্ন ব্যাচ/গ্রুপ তৈরি করে আমাদের আক্রান্ত করে। ডেঙ্গুর আতঙ্ক এর প্রাদুর্ভাবকে আরো ভয়াবহ করে তুলবে; বরং সর্বাধিক সচেতনতা ও মশক নিধনের উদ্যোগই আমাদের একমাত্র পথ। ডেঙ্গু নোংরা বা আবর্জনার চেয়ে স্বচ্ছ পানিতে বেশি বংশবৃদ্ধি করে।

তাই বলা যায়, বাইরের পরিচ্ছন্নের পাশাপাশি বাড়ি বা অভ্যন্তরীণ পরিবেশে ডেঙ্গুর বংশবৃদ্ধি বেশি সহজ। সরকার সর্বোচ্চ বাইরের পরিবেশটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে; কিন্তু বাড়ি, অফিস বা অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আমাদেরই। সুতরাং সরকার ও ব্যক্তি— যৌথ উদ্যোগ ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।

আমরা জানি, জমাটবদ্ধ পানিতে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি হয়ে থাকে। তাই খোলা স্থির পানিতে লবণ অথবা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে দিলে মশা প্রজনন করতে পারবে না। লবণাক্ত পানিতে লার্ভাগুলো বাঁচতে পারে না অথবা কেরোসিন তেল ঢেলে দিলে সেই পানিতে এডিস মশার লার্ভা বাঁচতে পারে না। কারণ উপরে তেল ভেসে থাকলে অক্সিজেনের ঘাটতিতে এডিসের লার্ভাগুলো মারা যায়। তবে কেরোসিন পরিবেশবান্ধন না হওয়ায় খাওয়ার সয়াবিন তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের সামান্য ব্যয়ে হাজার হাজার লোক ডেঙ্গুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবেন।
গত ৬ আগস্ট ডেঙ্গুতে একদিনেই ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও ডেঙ্গুর কল্যাণে মৃতপ্রায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এখন সদাব্যস্ত, অধিকাংশ প্রাইভেট হাসপাতালে সিট খালি নেই। ওষুধ কোম্পানির মুনাফার অঙ্ক বাড়ছে। স্যালাইনের চাহিদা আকাশচুম্বী। অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজি বা প্রাইভেট গাড়ির চাহিদা এখন ব্যাপক।

স্প্রে, কয়েল, ওডোমাস ক্রিম, মশারি বা মশা নিধনের সরঞ্জামাদি বিক্রির পরিমাণ কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। আর ডেঙ্গু নির্ণয়ের কিটের কৃত্রিম সংকট তো প্রথম থেকেই।

অপরদিকে ডেঙ্গুতে মৃত ব্যক্তির পরিবার, ডেঙ্গুর চিকিৎসাব্যয় বহন করতে গিয়ে টানাটানি হিসাবের পরিবার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা শ্রমজীবী— যাদের পরিবারের সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তাদের আয় সংকুচিত হয়ে গেছে।

একদিকে বন্যা, অপরদিকে ডেঙ্গুর প্রভাব এবং শ্রাবণের বৃষ্টিতে উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় এবার কৃষক বা খামারিদের যথেষ্ট ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। কোরবানির সময় পশুর হাটে অনেকেই ঢাকায় আসার জেরে ডেঙ্গু আক্রান্তের ঝুঁকিতে ছিল। আবার শহরের লাখ লাখ মানুষ ঈদ উপলক্ষে গ্রামে গিয়েছিল।

এদের অনেকেরই জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ফলে অভাবী, নদীভাঙা, বন্যায় কাহিল হওয়া এই মানুষগুলো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে মৃতের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যেতে পারে। কারণ ন্যূনতম চিকিৎসাব্যয় বহন করার ক্ষমতা তাদের নেই।

তাছাড়া অজপাড়াগাঁয়ের চিকিৎসা শহরের মতো এত উন্নত নয়। সর্বশেষ বলতে চাই, ডেঙ্গু নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আগাম বার্তা থাকা সত্ত্বেও প্রস্তুতি কী ছিল তা আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, পুরো জাতি আজ উদ্বিগ্ন।

ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, মশা হলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী— হয়তো আহত করবে, নইলে নিহত। আগে হানাদার বাহিনীর ভয়ে মানুষ লুকিয়ে থাকত; এখন আমরা মশার ভয়ে মশারিতে নিজেকে বন্দি করে রাখি। কিন্তু কতক্ষণ নিজেদের রক্ষা করতে পারব জানি না তবে সবাই সম্মিলিতভাবে সচেতন হলেই কেবল এ সংকট দূর করতে পারব, তা সুনিশ্চিত। চলুন নামি যুদ্ধে, ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!