• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা

সর্বোচ্চ শাস্তি চান আহতরা


বিশেষ প্রতিনিধি অক্টোবর ৯, ২০১৮, ০৯:৫৪ পিএম
সর্বোচ্চ শাস্তি চান আহতরা

ঢাকা : ২১শে আগস্ট ২০০৪। ক্যালেন্ডারের পাতায় পরিচিত এই তারিখটি দেখলেই শিউরে ওঠে গায়ের লোম। তখন মৃত্যু উপত্যকা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে ট্রাকে করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত ১০/১২টি মরদেহ। দোয়েল চত্বরের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ করে নড়ে ওঠে তার একটি। আর্তস্বরে ক্ষীণ ডাক- ‘মা, মাগো’। সতর্ক হয়ে ওঠেন মরদেহ বহনকারী স্বজনরা। শুরু হয় ট্রাক থামিয়ে জীবিতের সন্ধান।

এলোপাতাড়িভাবে ট্রাকে তোলা মরদেহের একেবারে নীচে গ্রেনেডে দুই পা উড়ে যাওয়া জীবিত মরদেহ! দ্রুত তাকে বাঁচানোর তাগিদে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগে, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন তার স্বজনরা, কিন্তু চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানান ডাক্তাররা। অ্যাম্বুলেন্সে শুধু ব্লুাড দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু একদিকে দেয়া হচ্ছে আর অন্যদিকে ব্লুাড সব বের হয়ে যাচ্ছে। রাত সাড়ে চারটার দিকে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে রেখে পরদিন সকালে বাংলাদেশ মেডিক্যালে অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয় ভারতে।

২০০৪ সালের একুশে আগস্টের সেই বিভীষিকাময় গ্রেনেড হামলার ‘জীবিত মরদেহ’ সংসদ সদস্য নাসিমা ফেরদৌসী। দেড় হাজারেরও বেশি স্প্লিন্টার শরীরে নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন তিনি। প্রতিমুহূর্তে তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় একুশে আগস্টের ভয়াবহতা।

শুধু নাসিমা ফেরদৌসীই নন; দীর্ঘ ১৪ বছর পরে আজও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে তাড়া করে ফেরে একুশে আগস্টের মৃত্যুদূত। নৃশংস সেই গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে পঙ্গুত্বের বোঝা নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন সাবিহা, রুমা, দীপ্তি, নাজিম, ফাহমিদা, সাজেদুল, দৌলতুন্নাহারসহ শত শত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। কেউ চলৎশক্তিহীন। কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। অনেকের শরীরে রয়ে গেছে অসংখ্য স্প্লিন্টারের অস্তিত্ব। সব মিলিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন এ মানুষগুলো।

এদের কজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের বর্তমান এই দুঃসহ জীবনের কথা। সেদিনের ভয়াবহতার কথা মনে এলে আঁতকে ওঠেন এখনো তারা। প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে দুঃস্বপ্ন। শরীরে বয়ে বেড়ানো স্প্লিন্টারগুলো গ্রেনেডের মতোই ক্ষত-বিক্ষত করে দেহ ও মন। অন্যদিকে, প্রিয়জন হারানোর বেদনা বুকে চেপে বেঁচে আছেন ভয়াবহ হামলায় নিহতদের স্বজনরা। তাই সর্বোচ্চ শাস্তি চান গ্রেনেড হামলায় মৃতদের পরিবার। হামলায় পরিকল্পনাকারীদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানান স্বজনরা।

এদিকে, গ্রেনেড হামলার পর থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আর্থিক সহযোগিতাসহ নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন নিহতদের অসহায় পরিবারগুলোর। আহতদের চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি ট্রাস্টসহ ২১শে আগস্ট গ্রেনেড অ্যাটাক ফান্ডের মাধ্যমে নিহত ও আহতদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগানো হচ্ছে। চাকরি পেয়েছেন অনেকেই। তার পরও যেন মন ভালো নেই তাদের। কারণ স্বজনহারার ব্যথা সেই বোঝে যার হারিয়েছে। তাই মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিহতদের স্বজনদের দাবি দুর্বৃত্তদের কঠিন সাজা হোক।

অন্যদিকে, এ ঘটনায় নিহত হন চাঁদপুরের দুই আওয়ামী লীগ নেতা। তাদের একজন কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবদুল কদ্দুছ, অপরজন আওয়ামী লীগ কর্মী আতিক উল্যাহ। আবদুল কদ্দুছের বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলায়, অপরজন মতলব উত্তরের পাঁচআনী গ্রামের বাসিন্দা।

দীর্ঘ ১৪ বছরেও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আতিক উল্ল্যাহ ও আবদুল কুদ্দুছের স্বজনরা। সরকারের প্রতি এ ঘটনায় নিহতদের শহিদ ঘোষণারও দাবি জানান তারা। পাশাপাশি  নিহতদের স্মরণে অন্তত একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করারও দাবি করেন স্বজনরা।

নিহত আতিক উল্যাহর স্ত্রী লাইলি বেগম বলেন, স্বামীর মৃত্যুর ১৪ বছর পার হলেও এখনো সে ভয়াবহ স্মৃতি পুরো পরিবারকে কাঁদায়। দ্রুত যেন খুনিদের বিচার হয়। আতিক উল্যাহর পরিবার নিহত আবদুল কুদ্দুছের বড় ভাই মো. হুমায়ুন কবির বলেন, হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করি। এছাড়া সরকারের কাছে আবদুল কুদ্দুছের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে তার নামে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করার দাবি জানাই।

হাইমচর উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. শাহজাহান পেদা বলেন, দিনটি স্মরণে উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। যারা শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে বর্বরোচিত এ হামলা করেছে তাদের বিচার শেষ হতে এতো দেরি হওয়াটা জাতির জন্য লজ্জার। আমরা এ ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করছি।

অপরদিকে, একই ঘটনায় মাদারীপুরে নিহত হন ৪ জন। সেই নিহতের পরিবারের সদস্যরাও নেই ভালো। এসব পরিবারে শোকের ছায়া কাটেনি এখনো। এখনো খুঁজে ফেরেন তারা তাদের সেই হারানো মানিকদের। ওই ঘটনায় আহতরা পঙ্গুত্ব নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে নিহত ও আহত পরিবারগুলো প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত দুই থেকে দশ লাখ টাকা অনুদান পেলেও এলাকার কেউ আর তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেননি।

কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামপোল গ্রামের বর্বরোচিত এ গ্রেনেড হামলায় নিহত শ্রমিক নেতা নাসির উদ্দিন ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন অন্ধ ভক্ত। নাসিরের বড় ছেলে মাহাবুব হোসেন জানান, বাবার উপার্জনেই চলত সংসার। বাবার মৃত্যুর পর টাকার অভাবে আমাদের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনোদিন আর্ধপেট আবার কোনোদিন খাবারই জোটেনি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। এখন সেই টাকার লভ্যাংশ দিয়ে আমার মা, আমি আর আমার ভাই নাজমুলকে নিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছি। আমি এখন ঢাকার বাংলা কলেজে বিএ পড়ছি, আমার ভাই গ্রামের কয়ারিয়া স্কুলে পড়ে। আমার যদি একটা চাকরি জুটে যেত তাহলে মা-ভাইকে নিয়ে একটু ভালো থাকতে পারতাম।

গ্রেনেড হামলায় অন্যদের মধ্যে নিহত সুফিয়া বেগমের বাড়ি রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামে। ওইদিন মহিলা নেতাদের সঙ্গে প্রথম সারিতেই ছিলেন সুফিয়া। চঞ্চলা ও উদ্যমী এই সুফিয়া বেগম সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন। নিহত হওয়ার পর তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। ঢাকার থাকার কারণে সুফিয়ার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালকিনি পৌরসভার বিভাগদি গ্রামের মোহাম্মদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদারের একটি পা গ্রেনেড হামলায় নষ্ট হয়ে গেছে। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছিলেন হালান। এখন সে ঢাকা ঘুরে ঘুরে মুরগির ব্যবসা করেন।

হালান বলেন, খোড়া পা নিয়ে কষ্ট হয় ঘুরে ঘুরে মুরগি বিক্রি করি। তাছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য স্প্লিন্টার। জ্বালা-যন্ত্রণায় অসহ্য লাগে মাঝেমধ্যে। হালান আরো জানান, সরকার যদি কোনো একটা চাকরি দিতেন, যাতে এরকম শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে না, তাছাড়া আমার চিকিৎসারও প্রয়োজন। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। সরকার সাহায্য করলে ভালো হতো।

কালকিনি পৌর এলাকার চরঝাউতলা গ্রামের সাইদুল ২১ আগস্ট ঢাকা পল্টন ময়দানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেট হামলার শিকার হয়ে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে অন্ধত্বের সঙ্গে জীবনযাপন করছে। এখনো তিনি বেকার। ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছিলেন তিনি। জানা গেছে, চরঝাউতলা গ্রামের মো. অহেদ সরদারের ছেলে মো. সাইদুল সরদার। তার বয়স ৫ বছর থাকতে মা মুঞ্জু বেগমকে হারায়। সেখান থেকে তার বাবা তাকে লেখাপড়া করার জন্য স্কুলে পাঠান। ক্লাস ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে টাকার অভাবে আর পড়তে পারেনি। এ ব্যাপারে সাইদুল জানান, গ্রেনেট হামলার শিকার হয়ে আমি চোখের দৃষ্টি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি।

ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলায় নিহত পটুয়াখালীর মামুর মৃধার বাড়িতে এখনো বইছে শোক। হামলাকারীদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বজনরা। এদিকে, একই ঘটনায় নিহত কুষ্টিয়ার মাহাবুবুর রশিদের স্মরণে স্মৃতি স্তম্ভ তৈরির দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

২০০৩ সালে এসএসসি পাস করে শ্রমিক বাবার সঙ্গে ঢাকাতে থেকে লেখাপড়া করতেন পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার আলীপুরা গ্রামের মামুন মৃধা। ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় যোগ দেন তিনি। হঠাৎ বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিমিষেই নিভে যায় তার জীবন। আর স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে যায় হতদরিদ্র পরিবারটির। ঘটনার ১৪ বছর পরেও হামলাকারীদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।

এছাড়া, একই ঘটনায় প্রাণ হারান প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন দেহরক্ষী কুষ্টিয়ার খোকশা উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামের মাহাবুবুর রশিদ। সেদিনের স্মৃতি আজও মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। তার স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি এলাকাবাসীর। তবে, মাহাবুবুর স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

এর আগে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে ঢাকায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার এক সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪ জন। যে ঘটনা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা হিসেবে পরিচিত। ঘটনার দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর মতিঝিল থানায় দায়ের করার হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা দুই মামলার রায় ঘোষণার জন্য আগামীকাল বুধবার (১০ অক্টোবর) দিন ধার্য করেছে ট্রাইব্যুনাল।

ঘটনার দিন: ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশ হচ্ছিলো আওয়ামী লীগের উদ্যোগে। সমাবেশের প্রায় শেষ পর্যায়ে তাতে বক্তব্য রাখছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। একটি ট্রাকের ওপর তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে তিনি বক্তব্য দেয়ার সময় তাকে ঘিরে ছিলেন দলীয় নেতারা। আর সামনের দিক থেকে তার ছবি তুলছিল অনেক ফটো সাংবাদিক।

বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়। ঘটনাস্থলে ছবি তুলছিলেন ফটো সাংবাদিক জিয়াউল ইসলাম। তিনি বলেন, এমন নৃশংসতা কখনো হতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিল না। আমি মঞ্চেই ছিলাম। চেয়ারে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি আর ধাক্কায় চেয়ার থেকে নীচে পড়ে যাই। আমার ওপরে পড়ে অনেকে। হঠাৎ ট্রাকের পাটাতনের ফাঁকে চোখে পড়লো আস্ত গ্রেনেড। সেটি বিস্ফোরিত হলে কি হতো ভাবতেও শিউরে উঠি এখনো।

শেখ হাসিনা কয়েক হাত দূরে। তাকে ঘিরে মানববর্ম তৈরি করেছেন তার দলের নেতারা। গ্রেনেডের শব্দ শেষে শুরু হলো গুলির শব্দ। এক পর্যায়ে উঠে দাঁড়াই এবং গুলি থামলে ট্রাক থেকে নেমে আসি। নামার পর যা দেখি সেটি আরেক বিভীষিকা। চারদিকে আর্তনাদ, গোঙ্গানি। রক্তাক্ত পড়ে আছে বহু নারী পুরুষ। কে জীবিত, কে মৃত, বোঝা মুশকিল। নিজে বেঁচে আছি বুঝতে পেরে আবার ক্যামেরার শাটারে ক্লিক করতে আরম্ভ করি। জ্ঞান ফিরে নিজেকে পেয়েছিলাম মরদেহের ট্রাকে।

সে দিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রযাত জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েকশ জন আহত হন।

মামলা দায়ের: গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার এসআই ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে তদন্তের দায়িত্ব পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। অবশ্য এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দুটি মামলা করেছিলেন। পরে এসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন: ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল।

অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল। যদিও ওই প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের এক আলোচিত অধ্যায় জজ মিয়া। ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় সেনবাগ থানায়।

ঢাকা থেকে সিআইডির অনুরোধ পেয়ে সেনবাগ থানাপুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের জন্য সোর্স নিয়োগ করে। পরে ৯ জুন বেলা ১টার দিকে জজ মিয়াকে আটক করে থানায় খবর দেয়। এর পর পুলিশ তাকে সেখান থেকে থানায় নিয়ে আসে। পনের দিন সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর গ্রেনেড হামলার মামলায় তিনি ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। পরে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয় যখন গণমাধ্যমে ফাঁস হয় যে জজ মিয়ার বিষয়টি পুলিশের সাজানো।

আসামি করার বদৌলতে তার পরিবারকে টাকা দেয়ার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। এর পর নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ২০০৮ সালে তাকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালত এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।

দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ই জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। এর পর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আখন্দ। তিনি ২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন।

সম্পূরক চার্জশিটে তারেক-বাবর : গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা মামলায় ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সে দিন বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ স্বাক্ষরিত চার্জশিটটি দাখিল করেন এসআই গোলাম মাওলা।

দুটি পৃথক ট্রাঙ্কে ভর্তি করে আনা চার্জশিটে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর আগের চার্জশিটে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। নতুনভাবে অভিযুক্তদের মধ্যে স্থান পান বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ উল্লেখযোগ্য।

এতে জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় ইতোমধ্যেই কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেয়া হয়। ফলে এ মামলায় এখন আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ২৩ জন এবং জামিনে ছিলেন ৮ জন। জামিনে থাকা ৮ জনের জামিন বাতিল করে আদালত।

৬ তদন্ত কর্মকর্তা: গ্রেনেড হামলার পর মামলা হয়েছিল পৃথক তিনটি। এর মধ্যে প্রথম ৭ বছরের মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় মোট ৬ বার। প্রথম তদন্ত হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কিন্তু কোনো প্রতিবেদন দাখিল হয়নি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নতুন তদন্তে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগ পত্রে মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হলেও গ্রেনেডের উৎস ও মদদদাতাদের শনাক্ত করা হয়নি। বর্তমান সরকার আমলে রাষ্ট্র পক্ষের আবেদনের পর আদালত মামলার বর্ধিত তদন্তের আদেশ দেন। ১৩ দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার তদন্ত শেষ হয়।

মামলার বিচার শুরু : এ হামলার মামলায়, খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের ২৮ মার্চ বুধবার। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় ওই বছর ৯ এপ্রিল পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। এর আগে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার শুরু হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে বিশেষ ট্রাইবুনালে৷

এ মামলায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমানসহ ২২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকার্য শুরু হয়েছিল৷ আদালত ৬১ সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছিলেন। আলোচিত এ মামলায় ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ গ্রহণ করা হয়েছে। আরও ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে।

দীর্ঘসূত্রিতার কারণ : মামলার দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে পরস্পরকে দায়ী করেছেন রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলা দুটি পাঁচবার উচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়ায় আদালতের ২৯২ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে।

এ ছাড়া তারা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে কালক্ষেপণ করেছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদিন মেজবাহ।

তিনি বলেন, এ মামলায় শুরুতে ৬১ জনের সাক্ষী নেয়ার পর অধিকতর তদন্তের আবেদন করা হয়। দ্বিতীয় রিপোর্ট আসা পর্যন্ত কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। এ ছাড়া প্রত্যেকটা আসামীর পক্ষে আলাদা আলাদা আইনজীবী জেরা করছেন। রাষ্ট্রপক্ষ ২২৫ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। এটা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। সবই হয়েছে আইনানুগ প্রক্রিয়ায়। কোনো কিছু সংক্ষিপ্ত করার কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান মেজবাহ।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। এ নিয়ে ১১৯তম কার্যদিবসে মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হলো। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০ ও আসামিপক্ষ ৮৯ কার্যদিবস ব্যয় করেছে। ঘটনার ১৪ বছর এক মাস ২০ দিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!