• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুরক্ষিত নয় চা শ্রমিক নারীরা


সেলিম আহমেদ সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৮, ১০:০৫ পিএম
সুরক্ষিত নয় চা শ্রমিক নারীরা

ঢাকা : দুটি পাতার একটি কুঁড়ি’ বললেই প্রথমেই আমাদের কল্পরাজ্যের মানসপটে ভেসে আসে সবুজে ঘেরা চা বাগানের উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা টিলায় বেষ্টিত অনিন্দ্য সুন্দরের সমারোহ। আবার প্রতিদিন সকালে কিংবা কাজের ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক না দিলে দূর হয় না ক্লান্তি, নিঃশ্বাস ফেলি সজীবতার। কিন্তু এই চা উৎপাদনে জড়িতদের নিয়ে কেউ কি কখনো চিন্তা করেছেন। কয়জনই বা জানি এসকল মানুষদের নিষ্পেষিত জীবন ব্যবস্থার কথা! আজ থেকে বহু বছর আগে বিট্রিশ শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগম ঘটে তাদের। এরপর থেকে বংশ পরম্পরায় তারা কাজ করছে চা বাগানে।

চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও নেপথ্যে মানুষগুলো নানা বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার হয়ে আসছে। চা শিল্পের উন্নয়ন হলেও ভাগ্যের পরির্বতন হয় না শ্রমিকদের। মধ্যযুগের ভ‚মিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাধা তার নিয়তি।

চা বাগানেই পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ৯৫ শতাংশ শ্রমিকই হচ্ছেন নারী। চা শ্রমিক নারীদের দিন শুরু হয় সেই কাকা ডাকা ভোরে। প্রতিটি নারী শ্রমিককেই তাড়াহুড়ো করে গৃহস্থালির কাজ শেষ করে ছোট ছোট সন্তানদের রেখে দলবেঁধে ছুটতে হয় বাগান পানে। এক চিমটে লবণ চা দিয়েই সকালের যাত্রা শুরু হয় চা শ্রমিকের। প্রতিদিন লাইন চৌকিদার, লেবার লাইনের নম্বরে যেয়ে চিৎকার দিয়ে চা শ্রমিকদের নম্বরের ঠিকানা দিয়ে থাকেন। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় তুফান সবকিছু মাথায় নিয়েই কাজে থাকতে হয় শ্রমিকদের। বৃষ্টি বাঁ ঝড় আসলে সামান্যতম আশ্রয়ের জন্য বাগানগুলোতেই নেই কোনো শ্রমিক ছাউনি। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসকল নারী শ্রমিকদের কে ঝোপঝাড়ই ভরসা, নেই কোনো স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থাও। নারী শ্রমিকরা শুধু পাতি (চা পাতা) উত্তোলনের কাজই করেন না । তারা কলম কাঁটা, চারা গাছ রোপণ থেকে শুরু করে গাছের আগাছা পরিষ্কার ও করার কাজেও নিয়োজিত থাকেন।

অথচ এসব নারী শ্রমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদাসীন বাগান মালিকরা। নেই তাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুবিধা। বাগানে কর্মরত প্রায় নারীকেই দেখা যায় রক্তশূন্যকা, স্বাস্থ্যহীনতা, জন্ডিস, ডায়রিয়া, জরায়ু ক্যান্সারসহ নানা রোগে ভূগতে। অসচেতনতা, কাজের নোংরা পরিবেশ, পরিচ্ছন্ন পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার অভাব, অপুষ্টিকর খাবার, নালা ও খালের পানির ব্যবহার, বাল্যবিবাহ, বেশি সন্তান নেয়া, নিয়ন্ত্রণহীন যৌনাচারসহ অপরিষ্কা-অপরিচ্ছন্নতার কারনেই চা শ্রমিকরার মূলত এসব রোগে আক্রান্ত হন।

আর্থিক অস্বচ্ছলতা, ভূমির সমস্যা, লোকবল বৃদ্ধি ও কিছুটা অভ্যাসগত কারনে চা বাগানের শ্রমিকদের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পয়:নিস্কাশন ব্যবস্থা নাজুক। বাগান কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়ন পরিষদ ও এনজিও সমুহের মাধ্যমে কিছু ল্যাট্রিন বিতরণ করা হলেও বিশাল শ্রমিক পরিবারের মধ্যে সেগুলো পর্যাপ্ত নয়।

চা শ্রমিকদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী প্রাথমিকভাবে জরায়ুমুখে ক্যান্সারে আক্রান্ত এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির এক জরিপে। এবছরের মে মাসে জরিপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেখা গেছে দেশের মোট বাগান ১৬৪টি বাগানে প্রায় ৯ লাখ চা জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী শ্রমিক। এই অর্ধেক নারী শ্রমিকের ১৫ শতাংশের শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। মৌলভীবাজারের রাজঘাট, খেজুরীছড়া, আমরাইলছড়া, সাঁতগাও, হোসেনাবাদ, আলীনগর, শমসেরনগর, মিরতিংগা, মাধবপুরসহ ১০টি বাগানে পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু দেশের সব চা বাগানে একই কাজ ও বাসস্থানের পরিবেশ বিদ্যমান সেহেতু চা বাগানগুলোতে একই অবস্থা থাকার সম্ভবনা প্রবল।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) অর্থায়নে জাতীয় স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির কারিগরি সহযোগিতায় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে মৌলভীবাজার জেলার চা বাগানে প্রজনন ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে বিবাহিত নারীদের জরায়ুমুখের ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য বিনামূল্যে 'ভায়া' টেস্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

সিআইপিআরবি সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানের মধ্যে দশটি চা বাগানে মোট তিন হাজার নারীর ভায়া টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৫১৯ জন দুরারোগ্য ক্যান্সার নামক ব্যাধিটি পজিটিভও এসেছে। এই ভায়া টেস্টের যে ভয়াবহ ফলাফল এসেছে তা চমকে দেয়ার মতো। তথ্যমতে চা বাগানে কর্মরত নারীদের শতকরা ১৫ জনের জরায়ুমুখে ক্যান্সারের লক্ষণ পাওয়া গেছে। এই কার্যক্রমে অংশ নেয়া নারীরা সাধারণত ২১ থেকে ৬৫ বছরের। চা বাগানে শিক্ষার অভাব থেকে ক্যান্সার তথা স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতনতা, কাজের নোংরা পরিবেশ, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতা যা জরায়ুমুখে ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

একজন চা শ্রমিক দৈনিক যে মজুরী পান তা দিয়ে চিকিৎসা করানো দূরের কথা পরিবারের খরচ যোগানোই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আর অধিকাংশ চা বাগানের নির্ধারিত কম্পাউন্ডারে (হাসপাতাল) গেলে সব রোগের ঔষধ হিসেবে দেয়া হয় কয়েকটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট।

চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও তেমনি ছেঁটে দেয়া চা গাছের মতো, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়ে ঘরে বন্দি। বাস্তবিক অর্থে যারা চা শ্রমিকের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন চা বাগানে সবুজের ছায়া ঘেরা ভাণ্ডারে কতটা অমানবিক ও বর্বর জীবন কাটাতে হয় শ্রমিকদের। বাগানের সবুজের হাসি আমরা খুব দেখতে পাই কিন্তু দেখতে পাই না কেবল শ্রমিকের কান্না এবং আহাজারি! দেখতে পাইনা কীভাবে মাত্র ১০২ টাকা দৈনিক মজুরী দিয়ে জীবনপার করে চা শ্রমিকরা। কখনো ভাবি না সবুজঘেরা বিস্তৃতপ্রান্তরে কীভাবে বর্বরোচিত জীবন আজও পরিচালিত করছে এই শ্রমিকরা; বিশেষত নারী শ্রমিকরা!

লেখক : সাংবাদিক, ই-মেইল : [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!