• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সেবা কেন্দ্রে ওষুধের জন্য হাহাকার


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ২৫, ২০১৬, ০৩:৫৩ পিএম
সেবা কেন্দ্রে ওষুধের জন্য হাহাকার

বিশেষ প্রতিনিধি

সারাদেশেই পরিবার  পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সেবা কেন্দ্রগুলোতে ওষুধের জন্য হাহাকার চলছে। ইতোমধ্যে ওই অধিদপ্তরের ২১টি আঞ্চলিক পণ্যাগারের (গুদাম) মধ্যে ওষুধশূন্য হয়ে গেছে ৬টি। আর অন্য ১৫টি পণ্যাগারে যে ওষুধ রয়েছে তা দিয়ে চলতি মাস পর্যন্ত কোনো রকম কার্যক্রম চালানো যাবে। ইতোমধ্যে ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় পণ্যাগার (ওষুধের গুদাম) থেকে গত ১৩ ডিসেম্বরের পর সারাদেশের ২১টি আঞ্চলিক পণ্যাগারে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। আবার ওসব আঞ্চলিক পণ্যাগার থেকেও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিকে বর্তমানে অঘোষিতভাবে ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীর মহাখালীর প্রধান পণ্যাগারে এখন ১৮ থেকে ২০ হাজার ডিডিএস (ড্রাগ অ্যান্ড ডাইটারি সাপ্লিমেনটেশন) কিটস মজুদ থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে সেখানে একশ’রও কম ডিডিএস কিটস রয়েছে। একটি কিটস বা প্যাকেটে থাকা ২৭ রকমের ওষুধ দিয়ে ৫০০ মা ও শিশুকে সেবা দেয়া যায়। কিন্তু গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) এ খাতে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক অর্থ বরাদ্দ না দেয়ায় সারাদেশে গত নভেম্বর মাস থেকেই ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, বিগত আশির দশক থেকেই দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় বাংলাদেশে রিভারসিবল পুল এইডেড (আরপিএ) কর্মসূচির আওতায় মায়ের প্রজনন স্বাস্থ্য ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। তার মধ্যে পুরুষদের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও রয়েছে। বর্তমানে একটি ডিডিএস কিটসে ২৭ ধরনের ওষুধের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপ, ড্রপ ও ক্রিম রয়েছে। আর মহাখালীর কেন্দ্রীয় পণ্যাগার থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ২১টি আঞ্চলিক পণ্যাগারের মাধ্যমে ৪৮৮টি উপজেলায় ডিডিএস কিটস সরবরাহ করা হয়। আবার উপজেলা থেকে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে ওষুধ সরবরাহ করা হয়। এভাবেই সারাদেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ওষুধের সঙ্কট মোকাবেলায় এক মাস আগেই পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা অর্থ ছাড় সম্পর্কিত একটি চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু এখনো সে অর্থ ছাড় হয়নি। ওই অর্থ জন্ম নিয়ন্ত্রণ তহবিল থেকে ছাড় করার কথা। বর্তমানে তহবিলে ৫০ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু অর্থ ছাড়ের বিষয়টি এখনো চিঠি চালাচালির পর্যায়ে সীমিত রয়েছে। সর্বশেষ গত ১১ জানুয়ারি অধিদপ্তর থেকে আরো একটি চিঠি দেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেলেও ওই ওষুধ কিনতে আরো প্রায় এক মাস সময় লেগে যাবে।

সূত্র আরো জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে সঙ্কট মোকাবেলায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিজস্ব তহবিল থেকে দুই সপ্তাহ আগে ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকায় ৩ হাজার ৬০০ ডিডিএস কিটস জরুরি ভিত্তিতে কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়। আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ওই ওষুধ কেন্দ্রীয় পণ্যাগারে সরবরাহের কথা রয়েছে। কিন্তু তা দিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কার্যক্রম চালানো যাবে। তারপর কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পণ্যাগারগুলোতে কোনো ওষুধ থাকবে না। কারণ গত ১৩ ডিসেম্বর মহাখালীর কেন্দ্রীয় পণ্যাগার থেকে ভোলার আঞ্চলিক পণ্যাগারে ৩০ প্যাকেট ও পটুয়াখালীর আঞ্চলিক পণ্যাগারে ৫০ প্যাকেট ডিডিএস কিটস সরবরাহ করা হয়। তারপর থেকে দেশের ২১টি আঞ্চলিক পণ্যাগারে কেন্দ্রীয় পণ্যাগার থেকে আর কোনো ওষুধ সরবরাহ করা হয়নি। আর গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় পণ্যাগারে ১৮২টি ডিডিএস কিটস ছিল। তারমধ্যে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নরসিংদীর বিভিন্ন উপজেলায় ৮০টি ডিডিএস কিটস সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া বর্তমানে আঞ্চলিক পণ্যাগারগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে ২২, বগুড়া শূন্য, ভোলা শূন্য, কুমিল্লা ৬, নোয়াখালী ৩, রাঙামাটি ৫৭, দিনাজপুর ২৭, রাজশাহী ২০১, যশোর শূন্য, কুষ্টিয়া ৪, ফরিদপুর ১৮, পটুয়াখালী ৪৩, খুলনা শূন্য, টাঙ্গাইল ১৮, জামালপুর ৫৫, ময়মনসিংহ ৬৬, রংপুর শূন্য, সিলেট শূন্য, বান্দরবান ১১, পাবনা ৩৩। সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পণ্যাগারে মাত্র ৬ শতাধিক ডিডিএস কিটস ওষুধ আছে।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় পণ্যাগারের মাধ্যমে সারাদেশে সেবাকেন্দ্রগুলোতে মাসে ৫ হাজার ডিডিএস কিডস প্রয়োজন। তার বিপরীতে গত মাসের শেষদিন পর্ষন্ত (৩১ ডিসেম্বর) ২১টি পণ্যাগারে ছিল ৮৪০ ডিডিএস কিডস। আর ১৪ দিনে তা কমে দাঁড়ায় ৫৬১-তে। অথচ ঢাকার আজিমপুরে ১৭৪ শয্যাবিশিষ্ট মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য হাসপাতাল রয়েছে। মোহাম্মদপুরে ১০০ শয্যার ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার আছে। এর বাইরে জেলা সদরে ৬০টিসহ সারাদেশে ৯৬টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র আছে। তাছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪২৭টি এমসিএইচ ইউনিট, ৪ হাজার ১১০টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং প্রায় ৩০ হাজার স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য এবং সাধারণ চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি মাসে ৩০ লাখ হিসাবে বছরে সাড়ে ৩ কোটির বেশি জনগোষ্ঠীকে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। কিন্তু ওষুধ সংকটের কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে মা-শিশু ও প্রসূতিসেবাঅ তাছাড়া বিবাহিত পুরুষের জন্য কনডমও সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭০ হাজার ডিডিএস কিটস কেনার উদ্যোগ নিয়েছিল। একই সাথে ওই অর্থবছরে সরকারের উন্নয়ন খাতের আওতায় ২ হাজার ২২২টি ডিডিএস কিডস কেনারও উদ্যোগ নেয়া হয়। দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর যখনই ওষুধ কেনার সময়, গত ১৯ মে বিশ্বব্যাংক থেকে আপত্তি জানানো হয়। তাতে করে আরপিএ কর্মসূচির আওতায় ডিডিএস কিডস কেনা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের শর্ত হলো একসাথে ওসব ওষুধ না কিনে আলাদাভাবে দরপত্র আহ্বান করে কিনতে হবে। ওই সময় বিশ্বব্যাংক অর্থ বরাদ্দ না দেয়ায় ওই ওষুধপত্র কিনতে পারেনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। তবে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারের উন্নয়ন খাতে যে ২ হাজার ২২২টি ডিডিএস কিডস কনার কথা ছিল তা কেনা হয়েছে। তবে শর্ত মানার পর চলতি (২০১৫-১৬) অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় সাড়ে ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২ ধরনের ওষুধের ৭০ হাজার ডিডিএস কিটস কেনার দরপত্র প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু হচ্ছে। তবে ওসব ওষুধ কিনতে আরো ৪ থেকে ৫ মাস সময় লাগবে।

এ প্রসঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ওষুধ সংকটের বিষয়ে সর্বশেষ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। তারপরই অ্যাসেনশিয়াল ড্রাগের মাধ্যমে ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত হয়। তাছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছেন কিভাবে দ্রুত ওষুধ কেনা যায়। সর্বশেষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ তহবিলের ২০ কোটি টাকার ভরসা করতে হচ্ছে। তবে এ টাকা পেলে যে ওষুধ কেনা যাবে তা দিয়ে মে মাস চালানো সম্ভব হবে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কেনা ওষুধ জুন মাসের মধ্যে চলে আসবে। তখন আর সংকট থাকবে না।

 

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!