• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সোনা চোরাচালানে সক্রিয় অর্ধশতাধিক সিন্ডিকেট


বিশেষ প্রতিনিধি নভেম্বর ১৫, ২০১৮, ১২:১৮ পিএম
সোনা চোরাচালানে সক্রিয় অর্ধশতাধিক সিন্ডিকেট

ঢাকা : দেশে সোনা চোরাচালানে সক্রিয় রয়েয়েছে ৭০টি সিন্ডিকেট। এর মধ্যে ১০টি সিন্ডিকেট পরিচালিত হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। আকাশ, স্থল ও সমুদ্র-তিন পথেই হয় সোনা চোরাচালান। দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়াও চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ২৯ বিদেশিকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড সূত্রে জানা গেছে, দেশীয় ৬০টি সিন্ডিকেটের মধ্যে ৪০টি সরাসরি এবং ১২টি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ও ৮টি ট্রাভেল এজেন্সি সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত আছে। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে পুরো সোনা চোরাচালানচক্রের সঙ্গে জড়িত আছে অন্তত ৫শ’ ৫৫ জন।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েতকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটগুলো মধ্যপ্রাচ্য বা দুবাই সিন্ডিকেট নামে পরিচিত। এর বাইরে পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং ও মায়ানমার থেকেও সিন্ডিকেট পরিচালিত হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, সোনার চোরাকারবারিরা সংঘবদ্ধ এবং তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। বেশ কিছু রাঘব বোয়াল গ্রেফতার আছে, যারা পলাতক আছে তাদেরকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সোনা চোরাচালানের বিষয়টি বহুপক্ষীয়। বিভিন্ন দেশের নাগরিকও এর সঙ্গে জড়িত। আর এর দেশীয় মূল হোতারা মূলত দেশের বাইরে থাকে। দেশে আসা মাত্র তাদের গ্রেফতারের উদ্যোগ আছে আমাদের।’

চোরাচালান হয়ে আসা সোনার গন্তব্য ভারত : বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এর মতে বাংলাদেশে চোরাচালান হয়ে আসা সোনার বড় অংশের গন্তব্যই ভারত। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ ঢালাওভাবে সোনা আমদানি নিষিদ্ধ করে ভারত সরকার।

এছাড়া সোনা আমদানির ওপর ছয় শতাংশ শুল্ক তিন দফায় বাড়িয়ে তা ১০ শতাংশ ধার্য করে ভারত। ফলে আমদানির চেয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে সোনার ব্যবসা করাই লাভজনক সেখানে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) বলছে, দেশে প্রতিদিন কম করে হলেও ২৫ কোটি টাকার সোনা কেনাবেচা হয়। আর পুরনো গয়না, প্রবাসীদের নিয়ে আসা সোনা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক নিলাম করলে যে সোনা পাওয়া যায় তা দিয়ে বাংলাদেশের ১০ হাজার জুয়েলার্সের চাহিদা পূরণ হয় বলে দাবি বাজুস’র। তবে এর সঙ্গে একমত নয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

তাদের মতে, নিলাম, পুরনো গয়না ও প্রবাসীদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আনা সোনা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। সোনা চোরাচালানের উল্লেখযোগ্য অংশ না হলেও একটা অংশ অবশ্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবহার হয়।

মূলহোতারা দেশের বাইরে : সোনা চোরাচালানের মূলহোতারা দেশের বাইরেই থাকেন। তাদের সঙ্গে বিদেশিরাও এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছে। গোয়েন্দাদের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের পাঁচ, ভারতের তের, সিঙ্গাপুরের দুই, নেপালের এক ও  পাকিস্তানের আট সোনা চোরাচালানির তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে। এছাড়া বিদেশে অবস্থান করে সোনা চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা ১৪ বাংলাদেশির তথ্যও আছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সিন্ডিকেট : আকাশ পথে চোরাচালান হয়ে আসা সোনার বাহক, বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, মাঝারি ও মধ্যম সারির চোরাকারবারি গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের নাগরিকের নাম বলেছে। এরা হলেন- হাম্মাম আল হাবিব, রসুল আমিন জুব্বা, পিয়াস আল মারহাবি, রামাতুল ফারাজি, আনসার উল্লাহ জসিম।

ভারতের সিন্ডিকেট : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে যাদের নাম আছে তারা হলেন- সুরেশ, আসিফ আহমেদ, অজিত, গোবিন্দ, বিজন হালদার, ল²ণ, গোপাল, কৃষ্ণ কুমার দাস, জুলহাস, রাতুল বাবু, কুমারজি, শ্যামল সাহা ও রামপাল।

সিঙ্গাপুরের সিন্ডিকেট : বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার চোরকারবারিরা জিজ্ঞাসাবাদে সিঙ্গাপুরের দুই নাগরিকের বিষয়ে তথ্য দিয়েছে। তারা হলেন- সিন্ডিকেট এনডি ও স্টিফেন।

পাকিস্তানি সিন্ডিকেট : গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পাকিস্তানের নাগরিকদেরও নাম আছে। তারা হলেন- আজমল হেলাল, মোহাম্মদ আলী, গিয়াস হাজারী, সোলায়মান, আব্দুর রহিম জিন্নাহ, আসিফ মোর্শেদী, রাজ্জাক ও হামজা। মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো থেকে সোনার চোরাচালান পরিচালনা করে পাকিস্তানি সিন্ডিকেট।

নেপালি সিন্ডিকেট : বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জিজ্ঞাসাবাদে সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নেপালের এক নাগরিকের সম্পর্কে তথ্য দেয়। তার নাম গৌরাঙ্গ রোসান।

বিদেশে বাংলাদেশি সিন্ডিকেট : মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে যেসব বাংলাদেশি সোনা চোরাচালান পরিচালনা করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে তাদের নাম উল্লেখ আছে। তারা হলেন- মতিয়ার রহমান খলিল, রেজাউল করিম, মোহাম্মদ আলী, মাসুদ করিম, মিন্টু, হামীম, সোনা রফিক, নাছির, গোল্ডেন মনির,নিজাম, রেজাউল, রবিউল, দেলোয়ার ও এমরান হোসেন।

আকাশ পথে চোরাচালানে মূলহোতার সহযোগী হিসেবে সিভিল এভিয়েশন ও শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী, পুলিশ, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার মাঠ কর্মকর্তা ও আনসার সদস্যদের নাম এসেছে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

সবচেয়ে বেশি আছে বাংলাদেশ বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের নাম। পাইলট, কো-পাইলট, ফ্লাইট স্টুয়ার্ট, ফ্লাইট পার্সার, চিফ পার্সার, কেবিন ক্রু, এয়ারক্রাফট মেকানিক, সহকারী এয়ারক্রাফট মেকানিক, জুনিয়র টেকনিশিয়ান, শিডিউল বিভাগ, ক্লিনিং বিভাগ, ক্যাটারিং বিভাগ, অপারেশন ও ট্রেনিং বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম আছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্যানুযায়ী, বিমানের কর্মীরা প্রতি দশ তোলার জন্য দেড় হাজার টাকা ঘুষ পায়।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, সোনা চোরাচালানের সঙ্গে বিমান থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন জড়িত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে। একজন উপজেলা চেয়ারম্যানকেও এ ঘটনা সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময়ে বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেফতার হয়েছে। তবে সবসময়ই এমনটা হচ্ছে বা সম্ভব তা মনে করেন না শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এই কর্মকর্তা।

আকাশপথে সোনা চোরাচালানের পাঁচ ধাপ-

প্রথম ধাপ : ‘ক্যারিয়ার’ বাছাই। মধ্যপ্রাচ্য দেশ-সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত,বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েত এবং পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে সোনা কেনার পর মূল হোতা ‘ক্যারিয়ার’ বা বাহক হিসেবে প্রবাসী শ্রমিক, লাগেজ ব্যবসায়ী বা পর্যটককে বেছে নেন। এরপর বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী হয়ে সোনা বহন করবেন এই শর্তে যাতায়াতের টিকিট ও কিছু নগদ টাকা দেওয়া হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা সিলেটের বিমানবন্দরে পৌঁছে সোনা না নিয়েই উড়োজাহাজ থেকে বের হয় ‘ক্যারিয়ার’।

দ্বিতীয় ধাপ : সিভিল এভিয়েশন, শুল্ক বিভাগ, বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় উড়োজাহাজ থাকা সোনা পৌঁছে যায় হ্যাংগার গেট বা কার্গো ভিলেজে।

তৃতীয় ধাপ : কার্গো ভিলেজের লোক সেখানে অপেক্ষমাণ প্রাইভেট কার,মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল এমনকি বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট গাড়ির মাধ্যমে চোরাচালানের সোনা বাইরে পাঠায়।

চতুর্থ ধাপ : এই ধাপে নির্ধারিত ব্যক্তির কাছে সোনা পৌঁছে যায় এবং পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সোনা তার কাছেই থাকবে। চতুর্থ ধাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মূলত কমিশনভোগী।

পঞ্চম ধাপ : এই ধাপে কমিশনভোগী চোরাচালানের সোনা পৌঁছে দেবে বাংলাদেশের ক্রেতার কাছে। এই ক্রেতা চোরাচালানের সোনা পৌঁছে দেবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে।

আকাশ পথে সোনা চোরাচালানের ৩০টি সিন্ডিকেট শনাক্ত করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

স্থলপথের চোরাচালানের তিন ধাপ : বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা চোরাচালানের পথ হিসেবে মূলত স্থল সীমান্তই ব্যবহার হয়। দুই দেশের সীমান্তে তাই সিন্ডিকেটের বিচরণ দেখা যায়। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস এমনকি যাত্রীবাহী বাসও ভারতে সোনাপাচারে ব্যবহার হয়।

স্থলপথে চোরাচালানের প্রথম ধাপ : পর্যটক হিসেবে ভারত থেকে আসা অথবা বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা বা পর্যটক ভিসায় যাওয়া নাগরিকরাই মূলত সোনা চোরাচালানের বাহক হয়। সীমান্তে পৌঁছে দিয়েই শেষ হয় তাদের কাজ।

দ্বিতীয় ধাপ : এই ধাপে মূলহোতার নির্ধারিত এজেন্ট বাহকের কাছ থেকে সোনা নিয়ে সীমান্ত কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন পার করে দেয়।

তৃতীয় ধাপ : ভারতীয় সীমান্ত পাড় হওয়ার পর সেখানকার মূতহোতাদের এজেন্ট নির্ধারিত গন্তব্যে চোরাচালানের সোনা পৌঁছে দেয়। স্থলপথে স্বর্ণচোরাচালানে সক্রিয় আছে ৩৫টি সিন্ডিকেট।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!