• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিতে থেকে এলো সুমি, কিন্তু গেলেন কীভাবে


সোনালীনিউজ ডেস্ক নভেম্বর ১৬, ২০১৯, ০৯:৩৫ এএম
সৌদিতে থেকে এলো সুমি, কিন্তু গেলেন কীভাবে

পঞ্চগড় : সৌদি আরবে চাকরি করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার সুমি আক্তার অবশেষে দেশে ফিরেছেন। বাঁচার আকুতি জানিয়ে তার ভিডিওবার্তা ভাইরাল হওয়ার পর শুক্রবার সকালে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।  এরপর পরিবারের কাছে তুলে দেওয়া হয়। তবে প্রশ্ন এসেছে, তিনি সৌদি গেলেন কী করে?

সুমি দেশে ফেরার পর জানা যায়, রূপসী বাংলা ওভারসিজ নামে যে রিক্রুটিং এজেন্সি তাকে সৌদি পাঠিয়েছিল, অনিয়মের অভিযোগে সেটির লাইসেন্স স্থগিত রয়েছে। স্থগিত লাইসেন্সে কর্মী পাঠানো যায় না। নিয়ম অনুযায়ী, ২৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের সৌদি আরব পাঠানো যায় না। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে বয়স বাড়িয়ে ২০ বছরের সুমিকে সৌদি পাঠানো হয়। এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে নির্যাতিতার নাম, পরিচয় ও ছবি প্রকাশ করা হয় না। সুমি যেহেতু তার ছবি এবং পরিচয় নিজেই প্রকাশ করেছেন তাই এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়েই তার পরিচয় পত্রিকায় গোপন করেনি।

কোনো মেয়েকে সৌদিতে পাঠানোর আগে তাকে প্রশিক্ষণ নিতে হয় জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি)। সুমি তা নেননি। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিএমইটি কিংবা বিমানবন্দর কোনো বাধাই পেরোতে হয়নি পঞ্চগড়ের মেয়ে সুমিকে। কীভাবে তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন- এর জবাব পাওয়া যায়নি।

জনশক্তি খাত সংশ্নিষ্টরা বলছেন, শুধু সুমি নয়, প্রতি ধাপে অনিয়ম করে এমন হাজারো মেয়েকে সৌদি পাঠিয়ে নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিচ্ছে দালাল চক্র। সম্প্রতি দেশে ফেরা ১২৪ নারী কর্মীর ১৮ জন ছাড়পত্র ছাড়াই সৌদি গিয়েছিলেন! ছাড়পত্র ছাড়া কী করে বিমানবন্দর পেরিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন, তা এখনও এক রহস্য।

সকাল সাড়ে ৭টায় এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইটে সুমি দেশে আসেন। তাকে সেখানে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়?নি। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক জহিরুল ইসলাম বিমানবন্দরে সুমিকে গ্রহণ করেন। এরপর তাকে পঞ্চগড়ের বোদায় নেওয়া হয়। সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদ হাসানের মাধ্যমে তাকে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

গত ৩০ মে সৌদি আরব গিয়েছিলেন সুমি। তাকে মাস চারেক পর বিক্রি করে নিয়োগ কর্তা। অত্যাচার সইতে না পেরে বাঁচার আকুতি জানিয়ে দেশে ভিডিওবার্তা পাঠান সুমি। তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে, তাকে ফেরাতে আন্দোলনে নামে বিভিন্ন সংগঠন। তাকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। আলোচনা গড়ায় সংসদে। সৌদিতে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধের দাবি ওঠে। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, বিদেশে ৯৯ শতাংশ মেয়ে ভালো আছে।

পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার পর সুমি আক্তার জানান, দুই বছর আগে তিনি ঢাকায় গিয়ে একটি গার্মেন্টে কাজ নেন। সেখানে নুরুল ইসলাম নামে আশুলিয়ার চারাবাগ এলাকার এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। মাস ছয়েক পর তাদের বিয়ে হয়। সংসারে সচ্ছলতা আনতে স্বামীর সহায়তায় 'রূপসী বাংলা ওভারসিজে'র মাধ্যমে গৃহকর্মীর ভিসায় সৌদি আরব যান। শুরু থেকেই তাকে অত্যাচার করা হতো। কফিল (নিয়োগ কর্তা) তাকে কক্ষে আটকে নির্যাতন করত, মারধর করত। একদিন হাতের তালুতে গরম তেল ঢেলে দেয়।

সুমি জানান, মাস চারেক পর সৌদি আরব-ইয়েমেন সীমান্ত এলাকার নাজরানের এক ব্যক্তির কাছে ২২ হাজার রিয়ালে (প্রায় পাঁচ লাখ টাকা) তাকে বিক্রি করে দেয় কফিল। নতুন কফিলও তাকে নির্যাতন করত। উদ্ধার হওয়ার আগে ১৫ দিন তাকে একটি ঘরে আটকে রেখে, খাবার দেয়নি, মোবাইল কেড়ে নেয়। স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে একদিন কান্নাকাটি করে মোবাইল হাতে পান। তারপর কৌশলে বাথরুমে গিয়ে ভিডিওবার্তা পাঠান। জীবন বাঁচাতে আকুতি জানান।

সুমির স্বামী নুরুল ইসলাম সেই ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করেন। তিনি  জানান, প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর সুমিকে বিয়ে করেন। মিরপুর-১ নম্বরে মাজেদা নামের এক দালাল সুমিকে বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। প্রলোভন দেখায়, বিনা খরচে সৌদি গিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পাবে সুমি। নুরুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, অভাবের তাড়নায় তিনি এ প্রস্তাবে প্রলুব্ধ হন। সুমিকে বিদেশ যেতে রাজি করান।

তারপর সুমিকে নিয়ে পল্টনে রূপসী বাংলা ওভারসিজের কার্যালয়ে যান। এজেন্সিই সুমির পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। সুমি বিদেশ যাওয়ার কোনো প্রশিক্ষণ নেয়নি। সৌদিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ জানিয়েছেন, দূতাবাস আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে সুমিকে উদ্ধার করে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। শুধু সুমি নয়, যে কোনো বাংলাদেশি কর্মী বিপদে পড়লে দূতাবাস এ ভূমিকা পালন করে।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান  বলেছেন, সুমির ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। নিয়ম অনুযায়ী ২৫ বছরের কম কোনো মেয়েকে সৌদি পাঠানো যাবে না। তবে ১৬-১৭ বছরের কিশোরীকেও বয়স বাড়িয়ে পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এর একমাত্র কারণ, মেয়ে কর্মী পাঠালে এজেন্সি টাকা পায়। সৌদি চায় বেশি সংখ্যক নারী কর্মী। তাই বয়স বাড়িয়ে, পাসপোর্টে ভুল তথ্য, ভুল ঠিকানা দিয়ে, অবিবাহিতকে বিবাহিত দেখিয়ে নানা ধরনের জালিয়াতি করা হয়।

শরিফুল হাসান জানান, আবার বিএমইটির স্মার্টকার্ড ছাড়া ভিসা দেওয়া হয়েছে এমন তথ্যও রয়েছে। বিমানবন্দরে সবসময় সব তথ্য যাচাই করা হয় না। কোনো মেয়ে বিপদে পড়লে কেউ দায়িত্ব নেয় না। এজেন্সি বলে তাদের দায়িত্ব কর্মী পাঠানো। সৌদিতে নির্যাতিত হলে, দায় তাদের নয়। কোনো মেয়ে নিপীড়িত হয়ে দূতাবাসে এলে তাকে দেশে পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করে বাংলাদেশ দূতাবাস। তারা বলে, সব কিছুর জন্য দায়ী রিক্রুটিং এজেন্সি। এভাবে সবাই একে অন্যকে দায়ী করে। তবে বাস্তবতা হলো, পাসপোর্ট তৈরি থেকে বিদেশে পাঠানো কিংবা সৌদি আরবে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়া প্রতিটি ধাপে ধাপে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার নজির আছে।

লাইসেন্স স্থগিত থাকার পরও কীভাবে সুমিকে সৌদি পাঠানো হয়েছিল, তা জানাতে অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি রূপসী বাংলার মালিক রজবুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সুমির বিষয়ে জানতে এসএমএস করার পর তিনি ফোন বন্ধ করে দেন।

রূপসী বাংলা রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সদস্য। বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদ এমপি  বলেছেন, লাইসেন্স স্থগিত আছে কিনা তা জেনে তিনি মন্তব্য করবেন। তবে কেউ দায়ী হলে তাকে প্রশ্রয় দেবে না বায়রা।

বায়রার একজন নেতা  বলেছেন, শুধু এজেন্সিকে দায়ী করলে হবে না। নারী কর্মীরা বিএমইটির ব্যবস্থাপনায় বিদেশ যায়। কোনো মেয়ে নির্যাতিত হলে ধরা পড়ে, তাকে অনিয়মের মাধ্যমে বিদেশ পাঠানো হয়েছে। সুমিকে সৌদি থেকে ফিরিয়ে আনলেও তার কফিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার কফিল সুমিকে বিক্রি নয়, অন্য নিয়োগ কর্তার কাছে দিয়েছিলেন। সৌদির আইনানুযায়ী এটা অন্যায়। এ অপরাধেই কফিলকে জেলে পাঠানো যায়। তা না করে সুমিকে দেশে এনে মালিককে রেহাই দেওয়া হয়েছে।

গত ১১ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী কল্যাণ সচিব সেলিম রেজা জানান, কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় লাইসেন্স স্থগিত হওয়ার আগেই কর্মী পাঠানোর ছাড়পত্র নিয়েছে এজেন্সি। এই অবস্থায় কর্মী পাঠাতে অনুমতি না দিলে ক্ষতি হবে কর্মীদেরই। তাই লাইসেন্স স্থগিতের আগে যেসব কর্মীর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, শুধু তাদেরই পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) নবনিযুক্ত মহাপরিচালক শামসুল আলম বলেন, তিনি কাজে নতুন যোগ দিয়েছেন। সুমিকে যে এজেন্সি পাঠিয়ে ছিল, তাদের লাইসেন্সের হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে জেনে মন্তব্য করবেন। লাইসেন্স বাতিলের পর কীভাবে কর্মী পাঠিয়েছে, তা খতিয়ে দেখবেন। এজেন্সি দায়ী হলে ছাড় দেওয়া হবে না। ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেছেন, সৌদিতে বাংলাদেশি মেয়েদের ওপর নির্যাতনে কোনো বিচার হয় না। তাই নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। নারীদের বিদেশে কাজের সুযোগ বন্ধ নয়, বরং নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাঠাতে হবে। নারী কর্মী পাঠাতে যেসব অনিয়ম চলছে, তা বন্ধ করতে হবে।

বাবা-মায়ের কাছে ফিরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুমি বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা না পেলে হয়তো প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারতেন না। সুমির অনুরোধ, আর কোনো মেয়ে যেন তার মতো বিপদে না পড়ে।

সোনালীনিউজ/এএস

Wordbridge School
Link copied!