• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সৌরভের চিঠি পেয়ে স্বপ্নের ঘোরে শাহরিয়ার বিদ্যুৎ


রবিউল ইসলাম বিদ্যুৎ নভেম্বর ১৯, ২০১৯, ০৪:৩৯ পিএম
সৌরভের চিঠি পেয়ে স্বপ্নের ঘোরে শাহরিয়ার বিদ্যুৎ

ঢাকা: ক্রিকেটের হাজার ওয়াটের আলো এখন তার ওপর ঠিকরে পড়ে না। পুরোদস্তুর ব্যবসায়ির খাতায় নাম লিখে ফেলেছেন বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের ওপেনার শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। ২০০৪-এ বিদায় বলার পর ক্রিকেট  থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছেন তিনি। কেউ নাকি চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়ে যায়। শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ-র বেলায়ও ঠিক তাই। ব্যবসায় এতটাই মন দিয়ে ফেলেছেন যে খেলাটাও ঠিকঠাক দেখা হয়ে ওঠে না। সেই শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ভারতীয় বোর্ডের (বিসিসিআই) সদ্য নিযুক্ত সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলির কাছ থেকে ইডেন গার্ডেন্সে যাবার আমন্ত্রণ পেয়ে আবেগে ভাসছেন। প্রহর গুনছেন ক্রিকেটের স্বর্গোদ্যানে পা ফেলার।

সাধ ছিল ইডেনে বল-ব্যাটের সংঘর্ষ ঘটাবেন। কিন্তু সাধ আর সাধ্য কখনো মেলেনি। তাই পা পড়েনি ইডেনের ২২ গজে। এবার সেই সুযোগ করে দিলেন স্বয়ং সৌরভ গাঙ্গুলি। এভাবেও যে স্বপ্নপূরণ হয় সেটা ভাবেননি শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। সোনালীনিউজকে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বলছিলেন,‘ স্বপ্ন ছিল ইডেন গার্ডেন্সে খেলব। কিন্তু ব্যাট নিয়ে ইডেনের ২২ গজে নামার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেছে। এবার দাদা (সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়) আমাকে সেই সুযোগ করে দিলেন। খেলতে পারিনি তো কী হয়েছে দাদা ইডেনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এটাই তো বিশাল ব্যাপার। প্রথম দিন-রাতের টেস্টে হাজির থেকে ইতিহাসের অংশ হয়ে যাব। এটাই বা কম কীসে!’

এখানেই না থেমে গড়গড় বলে চলেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ,‘ এত বড় সম্মান দেখাবে দাদা ভাবতে পারিনি। দাদা বাংলাদেশকে ভোলেননি, আমাদেরকেও ভোলেননি। সবাইকে আলাদা আলাদা করে চিঠি পাঠিয়েছেন। উনি মনের দিক থেকে অনেক বড়। তা না হলে এত বড় পদে থেকেও আমাদের মনে রাখেন? এর চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে!’

বাংলাদেশের হয়ে এমন দুটি রেকর্ড রয়েছে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ-র যেটা কখনোই কেউ ভাঙতে পারবে না। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ এবং প্রথম টেস্টে তিনিই প্রথম বল মোকাবেলা করেছেন। প্রথম টেস্টের স্মৃতি এখনো তাঁর কাছে জীবন্ত,‘ মনে হয় এই তো সেদিন। প্রথম ওভারেই আমি জাভাগাল শ্রীনাথের মুখোমুখি হয়েছি। সবসময় দুনিয়ার সব বড় বড় বোলারদের মুখোমুখি আমিই আগে হয়েছি। সত্যি বলতে প্রথম টেস্টের ওটা ছিল স্বপ্নের মতো এক মুহূর্ত। আমি ছিলাম ওপেনার। দাদাও তাই। উনার কাছ থেকেই টিপস নিয়েছি, কিভাবে লংগার ভার্সনে উইকেটে থাকা যায়।’

বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষের প্রতি এক ধরণের টান অনুভব করেন সৌরভ। সাকিব আল হাসান-মুশফিকুর রহিমরা লাল-সবুজের জার্সি গায়ে দারুন কিছু করে ফেললে তিনি কুর্নিশ করতে দেরি করেন না। সৌরভের এই বাংলাদেশ প্রেম কিন্তু আজকের নয়। সে কথা মনে করিয়ে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ বলছিলেন, ”যখন খেলতাম তখন থেকেই দেখতাম দাদার বাংলাদেশের প্রতি আলাদা টান। প্রথম টেস্টের সময়ই দেখেছি উনি ড্রেসিংরুমে এসে আমাদের সাথে কথা বলেছেন। আমাদের কাছে সেটা ছিল কল্পনাতীত। অভিষেক টেস্টের সকলকে ইডেনে আমন্ত্রণ জানিয়ে দাদা প্রমাণ করেছেন তিনি শুধু বড় ক্রিকেটার নন মানুষ হিসাবেও অতুলনীয়।“

বাংলাদেশের বেশিরভাগ ক্রিকেটপ্রেমী মনে করেন, দাদা ভারতীয় বোর্ডের সভাপতি হওয়ায় বাড়তি সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। সাধারণের মতো সাবেক বাংলাদেশি ওপেনারের মুখেও একই কথা,” দাদা থাকলে আমাদের ক্রিকেটের জন্য খুব ভাল। ওদের জন্যও ভাল। কারণ একজন খেলোয়াড়ই আরেকজন খেলোয়াড়ের কষ্টটা বোঝে। দাদা এসেই তো ওদের (ভারত) প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন বাড়িয়ে দিল। দাদা টপ ক্লাস ক্রিকেটার ছিলেন। উনি খেলোয়াড়দের সুবিধা-অসুবিধার ব্যাপারগুলো খুব ভাল করেই বোঝেন। দাদার বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা ফিলিংস আছে। আমার মনে হয়, উনার কাছ থেকে বাংলাদেশও সুবিধা পাবে।“

২০০০-এর নভেম্বরে অভিষেক টেস্ট খেলার পর যেখানে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ-এর নিয়মিত টেস্ট খেলার কথা ছিল সেখানে উল্টোটাই হয়েছে। চার বছর পর ২০০৪ সালে খেলেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় টেস্ট। সে বছরই রাগে ক্ষোভে বোর্ডকে চিঠি দিয়ে ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন অভিমানি বাংলাদেশি এই ওপেনার। ক্রিকেট ক্যারিয়ার তার আরও তিন-চার বছর লম্বা হতেই পারত। কিন্তু ফর্মে থাকার পরও দলে সুযোগ পাননি শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। সেই যন্ত্রণা-কষ্ট এখনো তাকেঁ তাড়িয়ে বেড়ায়। কখনো ক্ষোভে ফেটে পড়েন। 

আবার কখনো নিজেই সান্ত্বনা খুজেঁ নেন এই ভেবে যে, যতদিন খেলেছি অন্তত দু-চার জন মানুষ তো তাকেঁ চেনে। সেই কষ্টের কথা বলতে গিয়ে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ-এর গলা ধরে এল,‌“ জানেন, আমি নোংরা পলিটিক্সের শিকার হয়েছি। আমি কখনো টাকার জন্য খেলিনি। আমার কাছে সম্মানটাই বড় ছিল। ২০০৩ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের আগে আমি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে নারায়নগঞ্জের হয়ে চট্টগ্রামের বিপক্ষে সেঞ্চুরি মেরে দেই। আমি তো খুশি। এবার অস্ট্রেলিয়া সফরের দলে সুযোগ পাব। ক্যাম্পেও ডাক পেলাম। কিন্তু আমাকে সিলেক্ট না করে বলা হলো ‌‌’এ’ টিমের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যেতে। আমি না গিয়ে রাগ করে নিজেই বিকেএসপি থেকে গাড়ি চালিয়ে বাসায় চলে গিয়েছি।“

দারুন অভিমানি ছিলেন শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। তাঁর ব্যাটিংয়ে কোনো ভয়ডরের ছাপ ছিল না। ১৯৯৯ সালে মেরিল ইন্টারন্যাশনাল ত্রিদেশীয় সিরিজের আগে মেরিলিবন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) বিপক্ষে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি মেরে দিয়েছিলেন। ত্রিদেশীয় সিরিজে কেনিয়ার বিপক্ষে মোহাম্মদ শেখের বলে এলবিডব্লু হওয়ার আগে খেলেন ৯৫ রানের ইনিংস। সেই সময় এটাই ছিল কোনো বাংলাদেশির সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। যদিও তার রেকর্ডটি বেশিদিন টেকেনি। সেই সিরিজেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়েন তারই ওপেনিং পার্টনার বন্ধু মেহেরাব হোসেন অপি। সেই ম্যাচে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ-মেহেরাব হোসেন অপি ওপেনিং জুটিতে তুলে ফেলেছিলেন ১৭০ রান। সেই বছরই দুজনেই খেলে ফেলেন বিশ্বকাপ। পাকিস্তানের বিপক্ষে দুরন্ত জয়ে শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ খেলেন ৩৯ রানের ইনিংস। তারপরও ক্যারিয়ার লম্বা না হওয়ার পেছনে তিনি দায় দেখেন তৎকালীন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের।  

ক্ষোভ নিয়ে বাংলাদেশের মারকুটে ওপেনার বলে গেলেন,‘ সেই সময় প্রধান নির্বাচক ছিলেন ফারুক ভাই। এটা ২০০৪ সালের ঘটনা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে একটি ওয়ানডেতে ফিল্ডিং করার সময় থ্রো করতে গিয়ে পিঠে চোট পাই। ফিজিও পরীক্ষার পর জানালেন ওয়ানডে সিরিজে বিশ্রাম নিলে টেস্ট খেলতে পারব। হঠাৎই একদিন আমার কোচ ডেভ হোয়াটমোরের রুমে ডাক পড়ল। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন অধিনায়ক সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার) ও ফারুক ভাই। আমি তাদের বলেছিলাম ওয়ানডে সিরিজ শেষ হওয়ার পর টেস্ট সিরিজ খেলতে চাই। কিন্তু ফারুক ভাই আমাকে চাননি। তিনি বদলির খোঁজ করা শুরু করলেন। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম ফারুক ভাই আমাকে আর ডাকবেন না। আমি জীবনে কখনো কাউকে তেল মেরে খেলেনি। আর যাই হোক এটা আমাকে দিয়ে সম্ভব হতো না। বাড়ি ফিরে বাবা-মা এবং স্ত্রী’র সাথে কথা বলে বোর্ডকে চিঠি দিয়ে বিদায় বলেছি। আজ এতদিন পর সেসব আমি আর মনে রাখিনি। মনে রাখার চেষ্টাও করি না। এখন ফারুক ভাইয়ের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। নারায়নগঞ্জে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া ব্যবসায় মন দিয়েছি। এত ব্যস্ত যে ক্রিকেটীয় কোনো অনুষ্ঠানেও অনেক সময় যেতে পারি না।’

এখন সময় পেলে টুকটাক বাংলাদেশের খেলা দেখেন। শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ-র প্রিয় ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। তাঁর সঙ্গে তিনি নিজের ব্যাটিংয়ের মিল মিল খুঁজে পান। সেই তামিম পারিবারিক কারণে ভারত সফরে যেতে পারেননি। উল্টোদিকে, সাকিব আল হাসান নিষিদ্ধ হওয়ায় খর্বশক্তির দলই গিয়েছে ভারতে। ইন্দোর টেস্টে বড় হারের পর কলকাতায় ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বাংলাদেশ দল।

সাবেক এই ওপেনারও মনে করেন, কলকাতায় গোলাপি বলে ভাল করবে মুশফিকুর-মুমিনুলরা,‘ কলকাতার আবহাওয়া আর বাংলাদেশের আবহাওয়া একই। ওখানে খেললে মুশফিকরা ঘরের আমেজই পাবে। তাছাড়া পিচও এত ডিফারেন্ট হবে না। আমরা উপস্থিত থাকব। গলা ফাটাব ওদের জন্য। ভালো না খেলার তো কারণ নেই।’ শুধু শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ নন অভিষেক টেস্টের পুরো দলই ইডেনে হাজির থাকবেন। ভিভিআইপি বক্সে বাংলাদেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুশফিকুর-মুমিনুলদের তাই ভালো না খেলে উপায় আছে!  

সোনালীনিউজ/আরআইবি/এমএএইচ

Wordbridge School
Link copied!