• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে নকল সিগারেট


নিজস্ব প্রতিবেদক মে ৭, ২০১৯, ০৯:৫০ পিএম
স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে নকল সিগারেট

ঢাকা : ধূমপান মানুষের শরীরের সব অংশেরই ক্ষতি করে। এমন ক্ষতির কথা মাথায় রেখে সিগারেটের ব্যবহার কমাতে বর্তমান সরকার কয়েক বছর ধরে দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। আর এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে নকল সিগারেট উৎপাদন করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। নামিদামি ব্র্যান্ডের নাম দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে এসব সিগারেট।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় এমন একটি নকল সিগারেট কারখানার সন্ধান পেয়েছে কর কর্তৃপক্ষ। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ তামাকভর্তি সিগারেটের ফিল্টার ও মেশিন জব্দ করা হয়েছে। কারখানাটির বাইরে অটো রাইস মিলের সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল। কিন্তু ভেতরে সিগারেট উৎপাদনের মেশিনারিজ ছিল।

অভিযানে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর’ ‘গোল্ড লিফ’ ব্র্যান্ডের প্যাকেট পাওয়া গেছে। এগুলো যাচাই করে দেখা যায় এসব সিগারেট নকল। এসব নকল সিগারেট বাজারজাত করার কারণে এ খাত থেকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এখানেই শেষ নয়, সিগারেট খেলে যে ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নকল সিগারেটে। এ কারণে একদিকে যেমন সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে অন্যদিকে নকল সিগারেট খাওয়ার কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।

চিকিৎসকরা বলছেন, আসল সিগারেটের থেকে বেশি ক্ষতি হয় নকল সিগারেটে। এই সিগারেট খেলে মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধে। হতে পারে মস্তিষ্কের রোগ। গর্ভবতী নারীদের ধূমপানের কারণে অকালে গর্ভপাত হয়ে যায় বা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নেয়।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এসব নকল সিগারেট পান করার কারণে মুখ, দাঁত, জিভ ও ঠোঁটের ক্ষতি করে। ধূমপান থেকে ফুসফুসে, গলার নালিতে কর্কট রোগ হবার আশঙ্কা অত্যন্ত প্রবল থাকে। গর্ভবতী অবস্থায় মহিলারা ধূমপান করলে সিগারেটের ধোঁয়া শরীরের মধ্য দিয়ে প্লাসেন্টার ভেতর প্রবেশ করে এবং গর্ভস্থ সন্তানের রক্তে মিশে যেতে পারে। ধূমপানের কারণে শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এ বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি ও হেপাটোলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. মো মাহবুব আলম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যারা বিড়ি বা সিগারেট খান বা তামাকজাতীয় দ্রব্যের নেশা করেন, তাদের চোখে ছানি পড়ার আশঙ্কা অনেকটাই বেশি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অবৈধ সিগারেটের বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এজন্য প্রশাসনের কম নজরদারি ও কঠোর পদক্ষেপের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, সরকারের মোট রাজস্ব আয়ের ১০ ভাগ সিগারেট থেকে আসে। আর এ খাতের আয় প্রতি বছরই বাড়ছে। এ খাত থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে সরকার।

চলতি ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এ খাত থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের আশা করা হচ্ছে। এর আগে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ও ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেছে সরকার।

এসব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে এ খাত থেকে রাজস্ব আয় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। তবে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অবৈধ সিগারেটের বাজারের কারণে সরকার আরো প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের গত বছরের তথ্যানুযায়ী, রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিগারেটের ব্র্যান্ডের সংখ্যা ৪০টিরও বেশি।

সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় ৩০টি কোম্পানি ৫০টির বেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট উৎপাদন করছে। রংপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিভিন্ন বাজারে সেনর গোল্ড, ডার্লি, ব্ল্যাক, ভরসা, পার্টনার, দেশ ব্ল্যাক, টপি টেন, ফ্রেশ গোল্ড, সুপার গোল্ড, সেনর গোল্ড পিউর ইত্যাদি নামে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অবৈধ সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের সর্বনিম্ন দাম ৩৫ টাকা।

কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১০-১৫ টাকায় সিগারেটের প্যাকেট বিক্রি করছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অবৈধ ও নকল সিগারেটের এই বাণিজ্য বন্ধ করতে পারলে এ খাত থেকে বছরে আরও প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

 জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে জানা যায়, দামের ভিত্তিতে সিগারেটকে তিনটি স্তরে ভাগ করে রাজস্ব আদায় করা হয়। এর মধ্যে শুধু নিম্নস্তরের অর্থাৎ কম দামের সিগারেটের ভোক্তাই প্রায় ৭০ ভাগ। এ খাতের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৭১ ভাগ কম দামের সিগারেট থেকে আসে। এর মধ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫৫ ভাগ, মূল্য সংযোজন কর ১৫ ভাগ ও হেলথ সারচার্জ এক ভাগ।

এ হিসেবে ৩৫ টাকা মূল্যের প্রতি প্যাকেটের সিগারেট থেকে প্রায় ২৫ টাকা রাজস্ব আয় হয়। এই আয় নিশ্চিত করতে সিগারেট প্রস্তুতকারী সব প্রতিষ্ঠানকে প্রতিটি প্যাকেটের গায়ে ট্যাক্সস্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই ট্যাক্সস্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল ছাড়া কোনো সিগারেট বাজারে ছাড়া হলে সেটা আইনত অবৈধ। এ ছাড়া ট্যাক্সস্ট্যাম্প পুনর্ব্যবহার ও নকলভাবে সিগারেট উৎপাদন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ লি. এই ট্যাক্সস্ট্যাম্প উৎপাদনকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান। কেউ যদি অন্য কোথাও ট্যাক্সস্ট্যাম্প/ ব্যান্ডরোল উৎপাদন করে থাকে সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং নকল টাকা তৈরির মতোই বড় অপরাধ। অর্থনীতিবিদদের মতে, আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে বাংলাদেশ প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ।

তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্য রয়েছে। কিন্তু এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অবৈধ সিগারেটের বাজার। তাই এখনই এর লাগাম টেনে ধরতে প্রশাসনকে মাঠপর্যায়ে আরো কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি আমরা লক্ষ করছি নকল সিগারেট বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। যার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এ ছাড়া এসব সিগারেট পান করার কারণে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!