• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হজের পর হাজিদের করণীয়


এস এ মালিহা সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৯, ০৭:৪০ পিএম
হজের পর হাজিদের করণীয়

ঢাকা : ইসলাম ধর্মে বিশেষ অঙ্গভঙ্গি, অঙ্গ সঞ্চালন, জমকালো আয়োজন, ভ্রমণ কিংবা চিত্তবিনোদনমূলক কোনো কিছু ইবাদত নয়। ইসলামী মতে, মানবজীবনের মতো ইবাদতেরও দেহ-প্রাণ আছে। জাহেরি (দৃশ্যমান) আকৃতির সঙ্গে আছে বাতেনি (অদৃশ্য) শক্তি। বাহ্যিকতা ছাপিয়ে আধ্যাত্মিক ও অভ্যন্তরীণ প্রাণশক্তিই ইবাদতের অন্যতম শর্ত। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, কোরবানিসহ ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের বাহ্যিক আচরণের পাশাপাশি রয়েছে অন্তর্নিহিত দর্শন। বিত্তশালী, সচ্ছল ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। উপলব্ধি করা চাই—পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করে যে হজ পালন করা হয়, তা কেবল তীর্থযাত্রা কিংবা ভ্রমণেই শেষ হয়ে যায় না।

আল্লাহতায়ালার ঘোষণা মোতাবেক হজের উদ্দেশ্য হলো আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করা। তিনি ইরশাদ করেন, ‘নির্দিষ্ট মাসে (শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজে) হজ অনুষ্ঠিত হয়। অতএব, এই মাসগুলোতে যার ওপর হজ ফরজ হয়, সে যেন (হজে গিয়ে) স্ত্রী সম্ভোগ, অনাচার ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়। তোমরা যেসব সৎ কাজ করো, আল্লাহ তা জানেন। আর (পরকালের) পাথেয় সংগ্রহ করো, নিশ্চয়ই তাকওয়া বা আত্মসংযমই হলো শ্রেষ্ঠ পাথেয়’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৭)।

হজ হলো তাওহিদ তথা আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ববাদের আলোকে জীবন প্রতিষ্ঠার অন্যতম সহায়ক। কাজেই হজ থেকে তাওহিদের দীক্ষা নিয়ে ফিরতে হবে। মহান মাবুদ বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে মহান হজের দিনে মানুষের প্রতি (বিশেষ) বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রাসুলের সঙ্গেও নেই’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩)।

হজ থেকে ফেরার পর বিশেষ আমল : হজ থেকে ফিরে এসে নিকটস্থ মসজিদে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নাত। হজরত কাব বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে (নফল) নামাজ আদায় করতেন’ (বুখারি শরিফ)। হজ থেকে ফিরে শুকরিয়াস্বরূপ গরিব-মিসকিন ও আত্মীয়স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া বৈধ। ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় সে খাবারকে ‘নকিয়াহ’ বলা হয়। হজরত জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি গরু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবিরা তা থেকে আহার করেছেন’ (বুখারি)। তবে অহংকার, লোকদেখানো ও বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে এমন দাওয়াতের ব্যবস্থা করা ইসলাম অনুমোদন করে না।

ঘরে ফিরে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদাপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে, তখনো দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। সেই নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে।’

হাজি সাহেবদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুসাফাহ, কোলাকুলি করা এবং তাঁদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব। কিন্তু ফুলের মালা দেওয়া, তাঁদের সম্মানার্থে স্লোগান ইত্যাদি দেওয়া সীমা লঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত।

জমজমের পানি অন্য শহরে নিয়ে গিয়ে লোকদের পান করানো মুস্তাহাব। অসুস্থ রোগীদের গায়ে ব্যবহার করাও বৈধ। আয়েশা (রা.) জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘রাসুল (সা.) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন’ (তিরমিজি : ১১৫)।

আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে হাদিয়া-তোহফা দেওয়া সুন্নাত। কিন্তু মনের আগ্রহ ছাড়া কেবল প্রথা পালনের জন্য কোনো কাজ করা শরিয়তসম্মত নয়। ইসলামের যেকোনো ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর হুকুম পালনের জন্য হয়ে থাকে। ‘নামাজি সাহেব’ হওয়ার জন্য যেভাবে নামাজ পড়া হয় না, তেমনি ‘হাজি সাহেব’ হওয়ার জন্য হজ পালন করা অবৈধ। হ্যাঁ, মানুষ যদি এমনিতেই সম্মান করে ‘হাজি সাহেব’ বলে ডাকে, তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু নিজের নামের সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ‘হাজি’ বা ‘আলহাজ’ ব্যবহার করা কিংবা কেউ এ বিশেষণটি বর্জন করায় মনঃক্ষুণ্ন হওয়া গর্হিত কাজ।

সবশেষে বলি, হজ কবুল হওয়ার নিদর্শন হলো, এর ফলে জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে বিরত থাকার আগ্রহ বাড়ে। মানুষ আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি যত্নবান হয়। হজ করার পর যাঁর জীবনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসেনি, তাঁর হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। মনীষীদের একটি বহুল আলোচিত বাণী এখানে প্রণিধানযোগ্য। তাঁরা বলেছেন, ‘নেক কাজের প্রতিদান হলো এর পরেও নেক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, আর পাপ কাজের প্রতিদান হলো, এর পরেও পাপ কাজ অব্যাহত করে যাওয়া।’

বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজে যান। কিন্তু কয়জনই বা নিষ্পাপ হয়ে ফিরতে পারেন? সমাজে অনাচার কি কমছে? দেশ ও সমাজ তাঁদের মাধ্যমে যথাযথভাবে উপকৃত হতে পারছে কি? মক্কা-মদিনার জিয়ারত তাঁদের মধ্যে কি হানিমুন, শপিং, পর্যটন ও প্রমোদভ্রমণ উপলক্ষে দেশ-দেশান্তরে ছুটে চলার চেয়ে ভিন্ন কোনো অনুভূতি জাগ্রত করতে পেরেছে? যদি উত্তর নেতিবাচক হয়, তাহলে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। তাঁদের হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়।

লেখক : নিবন্ধকার

 

Wordbridge School
Link copied!