• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাউ, মাউ করে কেঁদে ফেলেন মুক্তিযোদ্ধা জাহিদুল ইসলাম


এম এ ইউসুফ, নওগাঁ সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯, ০২:৪০ পিএম
হাউ, মাউ করে কেঁদে ফেলেন মুক্তিযোদ্ধা জাহিদুল ইসলাম

নওগাঁ : প্রতি বছরের ন্যায় সাপাহারবাসীদের কাঁদাতে ও ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল বীভৎস দিনটি স্মরণ করিয়ে দিতে আবারো ফিরে এলো সেই ১৩ই সেপ্টম্বর। এই দিনে উপজেলার বেশ কয়েকজন স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা শত্রু সেনাদের কবল থেকে সাপাহারে অবস্থিত শত্রুপক্ষের শক্তিশালী মিলিটারি ক্যাম্প উৎখাত ও  সাপাহারবাসীকে মুক্ত করতে গিয়ে তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মৃত্যু বরণ করেছিলেন এবং বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছিলেন। তাই প্রতি বছর এই দিনে অনেক সন্তান হারা মা, পিতা হার ছেলে ও ভাই হারা বোন তাদের সেই নিহত সন্তান ও স্বজনদের কথা স্মরণ করে নিরবে চোখের পানি ফেলেন ও মাঝে মধ্যে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

এলাকার কয়েকজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ ব্যক্তিদের নিকট থেকে জানা যায়। ১৯৭১ সালে দেশে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হলে দেশের অন্যান্য এলাকার মত তৎকালীন স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারদের সহযোগীতায় সাপাহার উপজেলা ও পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়। বর্তমান উপজেলা সদরের পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় এলাকায় সে সময় তারা তাদের ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলে একটি শক্তিশালী ক্যাম্প। আর এই ক্যাম্পের নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর লেঃ কর্নেল মীর শওকত আলী।  

সেখান থেকেই তারা প্রতিদিন এলাকার চিহ্নিত রাজাকারদের দেয়া নির্দেশ মত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে সাধারণ নিরীহ মানুষের ধনসম্পদ লুট,পাট মা বোনদের ইজ্জত হরণ করে এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েক করে। যুদ্ধের প্রায় ৬ মাস অতিবাহিত হলে সেপ্টেম্বর মাসে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা নির্যাতনের স্বীকার সাপাহারবাসীকে মুক্ত করতে ও তাদের সেই শক্তিশালী ক্যাম্পটিকে চিরতরে উৎখাত করতে সাপাহার উপজেলার ও পার্শ্ববর্তী মহাদেবপুর উপজেলার ৮০ জন মুক্তি যোদ্ধার একটি সংগঠিত দল একত্রে সংঘবদ্ধ হয়। তৎকালীন পাকিস্থানী মিলিটারি বাহিনীর লেঃ কর্নেল মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে সু-সজ্জিত ওই ক্যাম্পটিকে সরিয়ে ফেলার জন্য তারা এক গোপন বৈঠকে বসে। দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।

শেষে, সময় ও সুযোগ বুঝে ওই দিনে ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে মুক্তি যোদ্ধার সজ্জিত দলটি তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি উপদলকে সাপাহার-মধইল রাস্তার মধইল ব্রীজে বাহিরের শত্রুদের গতি বিধি দেখার জন্য রাখা হয় আর একটি দলকে চারিদিকের পারিপার্শ্বিকতার অবস্থা পর্যবেক্ষণে সারাক্ষণ টহলে রাখা হয় এবং মূল দলটি ওই বিদ্যালয়ের উত্তর পূর্ব দিকে একটি ধান ক্ষেতে অবস্থান নেয়। ঠিক এসময় দেশের রাজাকার আলবদর মারফত মুক্তি যোদ্ধাদের আক্রমনের সংবাদ পৌঁছে যায় শত্রু শিবিরে তাৎক্ষণিক তারাও যুদ্ধের প্রস্ততি গ্রহন করে। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষে ভোর রাতে আক্রমণ চালায় ধান ক্ষেতে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মূলদলটি, পাইলট মাঠ থেকে শত্রু সেনারাও পাল্টা আক্রমন চালাতে শুরু করে। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এক টানা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা আয়ুব আলী পাকবাহিনীর অধিনায়ক লেঃ কর্নেল মীর শওকত আলীকে নিহত করে।

মুক্তিযোদ্ধার দলটি যখন পাক সেনাদের প্রায় কোন ঠাসা করে ফেলেছিল ঠিক তখনই ভোরের আভাস পেয়ে মধইল ব্রীজে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধার উপদলটি সেখান থেকে সরে পড়ে আর সে মুহূর্তে পত্নীতলা উপজেলা সদর ও মধইল বাজার এলাকা থেকে অসংখ্য পাক সেনারা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সাপাহারে প্রবেশ করে। নতুন শত্রু সেনার অনুপ্রবেশে শত্রুবাহিনীর শক্তিদ্বিগুণ হারে বেড়ে যায় এবং তারা এক সময় স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার দলটিকে ধরাশায়ী করে ফেলে।

এ সময় শত্রু সেনার বুলেটের গুলিতে যুদ্ধের মাঠেই শাহদাৎ বরণ করেন মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান, আইয়ুব আলী, আব্দুল হামিদ সহ ১৫ জন। আহত হন মুক্তিযোদ্ধা মনছুর আলী, এস এম জাহিদুল ইসলাম, দলনেতা আহম্মদ উল্লাহ, সোহরাব হোসেন, নুরুল ইসলাম সহ অনেকে। এছাড়া শত্রুদের হাতে জীবিত ধরা পড়েন ৮জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এসময় শত্রু সেনারা যুদ্ধের মাঠ থেকে সাপাহারের তিলনা গ্রামের আবু ওয়াহেদ গেটের, মহাদেবপুর উপজেলার এসএম জাহিদুল ইসলামসহ ৮জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনে মধইল স্কুলের ছাদে তুলে ৪ জনকে কুপিয়ে হত্যা করে লাশগুলি লাথি মেরে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়। অপর ২ জনকে মহাদেবপুর এনে একটি কুপে ফেলে দিয়ে জীবন্ত কবর দেয় আর আবু ওয়াহেদ গেটের ও এসএম জাহিদুল ইসলামকে ধরে এনে নাটোর জেলাসদরে তৎকালীন তাদের তৈরীকৃত রাজবাড়ীর জেলখানায় বন্দী করে রাখে।

পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এস এম জাহিদুল ইসলাম ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রতিবেদকের সামনে হাউ, মাউ করে কেঁদে ফেলেন ও ঘটনার বর্ণনা দেন। তাই আজকের এই দিনে সাপাহারে অনেকে দিনটির কথা স্মরণ করে অঝোরে তাদের চোখের পানি ফেলেন ও ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন।

সোনালীনিউজ/এমএইউ/এএস

Wordbridge School
Link copied!