• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দাবি ৫৫ কোটি টাকা


সোনালীনিউজ ডেস্ক নভেম্বর ৭, ২০১৯, ০৩:৩৪ পিএম
১৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দাবি ৫৫ কোটি টাকা

ঢাকা: ১৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১৯ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও ঋণের টাকা শোধ হচ্ছে না। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আরও দাবি করছে ৩৩ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমন ঋণ নৈরাজ্যের অভিযোগ ভূরিভূরি। তবে এবার ঋণগ্রহীতার অভিযোগ মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, ১৩ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে এক টাকাও পরিশোধ না করলে ট্রাস্টের সর্বোচ্চ দায় ৩৯ কোটি টাকার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে ফিনিক্স ৫৫ কোটি টাকার দাবি তুলেছে।

২০০৮ সালের এপ্রিলে ফিনিক্স ফাইন্যান্স ইনভেষ্টমেন্ট লিমিটেড নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের তৎকালীন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান আইবিএটি ট্রাস্ট (বর্তমানে এনইউবি ট্রাস্ট) মিরপুর রোডে অবস্থিত গ্লোব শপিং সেন্টারের ৭, ৮, ৯ ও ১০ নাম্বার ফ্লোর ১৮ কোটি ৭৬ লাখ মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

একই দিনে ৩৭৭৪৬ বর্গফুটের ৪টি ফ্লাটের বিক্রি তড়িৎ করতে আইবিএটি ট্রাস্ট (বর্তমানে এনইউবি ট্রাস্ট) কে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা উচ্চ সুদ হারে প্রদান করে। এরপর ২০১৭ সাল পর্যন্ত সুদসহ প্রায় ১৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে এনইউবি ট্রাস্ট। ৬ কোটি বেশী দিয়েও ঋণের টাকা শোধ হচ্ছে না।

ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স ফাইন্যান্স ইনভেষ্টমেন্ট লিমিটেড আরও দাবি করছে ৩৩ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এমন ঋণ নৈরাজ্যের অভিযোগ রয়েছে আরো। তবে এবার বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত, দুর্ণীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংক ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব) পর্যন্ত।

এরই মধ্যে ঘটে আরেক ঘটনা। ফিনিক্সের মালিকাধীন গ্লোব কনষ্ট্রাকশনের সম্পত্তি বন্ধক থাকার তথ্য গোপন করে ট্রাস্টের নামে তিনটি ফ্লোর রেজিস্ট্রি করে দেয়া হয়। একপর্যায়ে জানা যায়, ফিনিক্সের বিক্রি করা সম্পত্তি মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নিকট বন্ধক রয়েছে। এ ঘটনা জানার পর ফিনিক্সের কাছে কৈফিয়ত চায় ট্রাষ্ট। কিন্তু ফিনিক্স কোনো যুক্তিযুক্ত জবাব না দিয়ে টালবাহনা করে পাশাপাশি ঋণের বাকী টাকা দাবি করে।

পরে ফিনিক্স দাবি করে বিক্রীত সম্পত্তি সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক। ব্যাংকে দায়বদ্ধ থাকার বিষয়টি তাদের জানা নেই। উভয় পক্ষের চিঠি চালাচালির একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আরেকটি চিঠি হাতে পায় আইবিএটি ট্রাস্ট। যাতে ফিনিক্সের জালিয়াতির বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়।

কারণ, ট্রাস্টের কাছে সম্পত্তি বিক্রির এক বছর আগে ২০০৭ সালের ৯ আগস্ট এক পত্রের মাধ্যমে ফিনিক্স ফাইন্যান্সকে বন্ধক সম্পর্কে অবহিত পত্র দেয় ব্যাংক। কিন্তু বিষয়টি জানার আগেই ফিনিক্স ফাইন্যান্সকে সুদসহ ঋণের ১৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়ে যায়।

এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে আইবিএটি ট্রাস্ট। একদিকে সুদসহ বিপুল অংকের টাকা পরিশোধ করা হয়ে গেছে, অন্যদিকে ব্যাংকে বন্ধক থাকায় সম্পদের নিষ্কণ্টক মালিকানাও পাওয়া যাচ্ছে না।

বর্তমানে উভয় প্রতিষ্ঠান এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। দু’পক্ষই নিজেদের দাবিতে অটল। দ্বন্দ্ব নিরসনে উভয় পক্ষের মধ্যে একাধিক সমঝোতা বৈঠক হলেও তা সফল হয়নি। ইতিমধ্যে বিষয়টির মীমাংসা চেয়ে একাধিক আবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়িয়ে দুদক কার্যালয়েও পৌঁছেছে।

এ প্রসঙ্গে ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানকে ফোন দেয় হলে, ফোন ধরেন তার পিএস। তার নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি নাম বলেননি। এছাড়া অপর প্রান্তে আজিজুর রহমানের পিএসকে শিখিয়ে দেয়া হয় উনি নেই। পাশ থেকে কেউ একজন বলে ‘বল উনি নেই’। পিএস বলেন, আপনি রং নাম্বারে ফোন দিয়েছেন, উনি নাই এখন, উনি ফোন দোকানে রেখে গেছেন।

এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম ইন্তেখাব আলমকে দৈনিক সকালের সময় থেকে বেশ কয়েকবার ফোন ও মেসেজ দেয়া হলে কোনটিরই উত্তর দেননি তিনি।

এ প্রসঙ্গে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার অধ্যাপক কাজী শাহাদাত কবির রিমন বলেন,  ঋণের ফাঁদে ফেলে অভিনব উপায়ে ফিনিক্স ফাইন্যান্স আমাদের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি একদিকে যেমন, সত্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের কাছে বন্ধক থাকা সম্পদ আমাদের কাছে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে বার বার সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হলে শুনছে না প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকে অভিযোগ দিয়েছি।  

দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকে বন্ধকী সম্পদ বিক্রির অভিযোগ: এ বছরের ২৫ জুন মামলার এজাহার ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের সঙ্গে আইবিএটি ট্রাস্টের একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ফিনিক্স তাদের মালিকানাধীন ৪টি বাণিজ্যিক ফ্লোর ট্রাস্টের কাছে বিক্রি করবে।

যার দাম ধরা হয় ১৮ কোটি টাকা। এজন্য ট্রাস্টের নামে উচ্চ সুদে ১৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় ফিনিক্স। ঋণদাতা ও সম্পত্তি বিক্রেতা একই প্রতিষ্ঠান হওয়ার সুবিধা কাজে লাগায় ফিনিক্স। নজিরবিহীনভাবে তারা একদিক দিয়ে ঋণের নামে টাকা ছাড় করে, অন্য দিক দিয়ে ফ্লোর বিক্রির নামে টাকা ফিরিয়ে নেয়। ২০১৭ সাল থেকে অধ্যাবদি বছর পর্যন্ত  আইবিএটি ট্রাস্ট একই  ধরনের অভিযোগ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর বরাবর।  

একপর্যায়ে ঘটনার বিশদ বিবরণ দিয়ে বিষয়টি লিখিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপর্যায়কে জানানো হয়। ২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর আইবিএটি ট্রাস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজারকে লেখা এক চিঠিতে জানায়, ফিনিক্স ফাইন্যান্স ২০০৮ সালের ১০ জুলাই ৪টি ফ্লোর বিক্রির জন্য আইবিএটি ট্রাস্টের সঙ্গে চুক্তি করে।

একই তারিখে তারা ট্রাস্টের অনুকূলে ১৩ কোটি টাকা ঋণও মঞ্জুর করে। একই দিনে সম্পত্তি বিক্রির চুক্তি ও দ্রুততম সময়ে ঋণ মঞ্জুরের প্রক্রিয়া দেখলেই বোঝা যায়, ত্রুটিপূর্ণ সম্পত্তি দ্রুত বিক্রির জন্য তড়িঘড়ি ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।

দুদক চেয়ারম্যান বরাবর দেয়া অপর এক অভিযোগে বলা হয়, একদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পদ বিক্রি অন্যদিকে ট্রাস্টকে ফাঁদে ফেলে কৌশলে ঋণের তিন গুণ টাকা আদায়ের কৌশল ফিনিক্সের। দুর্ণীতির মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে তারা দ্রুত ঋণ দেয়ার নামে ত্রুটিপূর্ণ সম্পত্তি ট্রাস্টের কাছে বিক্রি করে।

পরে অনেকটা মরিয়া হয়ে বন্ধকী ফ্লোর বিক্রির জবাব চেয়ে ফিনিক্স ফাইন্যান্স কর্তৃপক্ষকে দফায় দফায় চিঠি দেয় আইবিএটি ট্রাস্ট। সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসার উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই সাড়া দেয়নি ফিনিক্স। উল্টো ঋণের সুদসহ কথিত পাওনার অংক তারা বাড়িয়েই চলে। ট্রাস্টকে টাকা পরিশোধের জন্য নানা হুমকিও দেয়া হয়।

এ বিষয়ে যথাযথ কৈফিয়ত চাওয়া হলে ফিনিক্সের পক্ষ থেকে কোনো সদুত্তর দেয়া হয়নি। উল্টো বারবার তারা ঋণের টাকা পরিশোধের তাগাদা দেয়। এমনকি বেআইনিভাবে নানা উসিলায় দ- সুদ, বকেয়া সুদ এবং চক্রবৃদ্ধি সুদসহ আরও নানা নিয়মের মারপ্যাঁচে ফেলে ঋণের অংককে পাহাড়সম বানায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ  ফিনিক্স ট্রাস্টের কাছে ৫৫ কোটি টাকা পাওনা দাবি করেছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী, ১৩ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে এক টাকাও পরিশোধ না করলে ট্রাস্টের সর্বোচ্চ দায় ৩৯ কোটি টাকার বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। সেখানে ফিনিক্স ৫৫ কোটি টাকার দাবি করছে। ঋণের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ না করায় ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্বিন্যাস করায় আরোপিত সুদসহ সমুদয় পাওনা অনুমোদিত ঋণের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গেছে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন ও বিধি মোতাবেক পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুদ ধার্যের গাইড লাইন অনুযায়ী  ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণ হিসাবে সুদধার্য করার কথা, সেখানে ফিনিক্স ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেষ্টমেন্ট লিঃ মাসিক ভিত্তিতে সুদ চার্য করে চলেছে। যার ফলে- সুদের হার যদি ১৮% হয়, তাহলে মাসিক ভিত্তিতে সুদ ধার্যের ফলে এই সুদের হার ত্রৈমাসিক দাঁড়ায় ১৮%+১%+১%+১% = আনুমানিক ২১% এবং বৎসরান্তে দাঁড়ায় ২৫%। এরপর সামান্য খেলাপী হলে দন্ডসুদ, বিলম্বসুদ ধার্যের ফলে ঋণগ্রহীতার ঋণবকেয়া একটি বিশাল অংকে দাড়িয়ে যায়।

অন্যদিকে সমঝোতার সব প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হয় আইবিএটি ট্রাস্ট। প্রতারণার মাধ্যমে সম্পত্তি বিক্রি ও চেক জালিয়াতির অভিযোগে গত বছর মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে দায়েরকৃত মামলায় আসামি ফিনিক্স ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

ফিনিক্স ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেষ্টমেন্ট লিঃ তাদের এধরনের অনৈতিক কাজ, প্রতারনা ও জালিয়াতি ধামাচাপা দিয়ে রামরাজত্ত কায়েম করেছে এবং এই লক্ষ্যে বিভিন্ন ল’ফার্মকে নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমে গ্রাহক খাতকে হয়রানী করে চলেছে। তাদের ধারনা অঢেল টাকা খরচ করে তাদের অপকর্ম ঢাকা দেওয়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থমন্ত্রনালয় ও সরকারকে অন্ধকারে রাখা। তাদের এধরণের অনৈতিক কাজের জন্য নিরীহ গ্রাহকযাতক সুবিচার প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে আইবিএটি ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ। সকালের সময়

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!