• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

১৫ বছর ধরে নাপিতের কাজ করেন শেফালী!


সোনালীনিউজ ডেস্ক জুলাই ৩, ২০১৯, ১১:২৯ এএম
১৫ বছর ধরে নাপিতের কাজ করেন শেফালী!

ঢাকা: নারী নরসুন্দর শেফালী রানী। জীবিকা নির্বাহে বিনা দ্বিধায় ১৫ বছর ধরে পুরুষের চুল-দাড়ি কাটছেন ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার দোগনা বাজারে। এ কাজে যা আয় হয় তাতেই চলছে তার ছয় সদস্যের সংসার।

অন্যের চুল-দাড়ি কেটেই পাঁচ ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচও চালান শেফালী। মেজ মেয়ে বিথিকা বিএ তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। অন্য ছেলে-মেয়েরাও পড়ালেখা করছেন।

দোগনা বাজারে এক প্রবাসীর বসতঘরের বারান্দায় সারাদিন পুরুষের সৌন্দর্য্য বর্ধনে কাজ করেন নরসুন্দর শেফালী। আধুনিক বিভিন্ন স্টাইলের চুলের কাট দিচ্ছেন তরুণ যুবকদের। কম টাকায় চুল-দাড়ি কামিয়ে স্বস্তিও পাচ্ছেন স্থানীয়রা।

নারী হয়ে পুরুষের সৌন্দর্য্য বর্ধনের সাহসী পদক্ষেপ নেয়ায় জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাকে দিয়েছে জয়িতা সন্মাননা। শেফালী রানীর দাবি আর্থিক সহায়তা পেলে তিনি দোগনা বাজারে একটি আধুনিক সেলুন গড়ে তুলবেন।

জানা গেছে, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শেফালী রানী শীলের বিয়ে হয়। স্বামী বিশ্বনাথ শীলের দোগনা বাজারে সেলুন ছিল। অন্যের চুল-দাড়ি কামিয়ে স্বামী যা আয় করতেন তা দিয়ে কোনো রকম  চলে যেতো তাদের সংসার। একে একে তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয়  চার মেয়ে ও এক ছেলে।

পনের-ষোল বছর আগে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন স্বামী বিশ্বনাথ। বন্ধ হয়ে যায় শেফালীর সংসারের চাকা। নিজের চিকিৎসা এবং সংসারের খরচ চালাতে না পেরে নিরুদ্দেশ হয়ে যান বিশ্বনাথ। বিয়ের আগে অথবা বিয়ের পরে শেফালী কখনো চিন্তাও করেননি পুরুষের চুল-দাড়ি কেটে তাকে সংসার চালাতে হবে।

স্থানীয়রা জানান, শেফালীর শুরুটা ছিল খুবই কঠিন এবং ব্রিব্রতকর। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পরে ছেলে-মেয়ে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করেন শেফালী। নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নেন স্বামীর পেশাকেই ধারণ করবেন। বাজারে পুরুষের চুল-দাড়ি কাটার কাজ শুরু করলে প্রথমে বাধা বিপত্তি আসে। স্থানীয় সমাজপতিদের হস্তক্ষেপে বাধা দূর হয়। এখন শেফালী রানীর সামনে কোনো বাধা নেই। অনেকেই তার প্রশংসা করছেন।

তবে শেফালী রানী এখন পর্যন্ত কোননো সরকারি দপ্তর থেকে আর্থিক সহায়তা পাননি। ইচ্ছে করলে তাকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে স্বাবলম্বি হতে সহায়তা করতে চায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর।

শেফালীর সেলুনে চুল কাটতে আসা কৃষক তৈয়ব আলী হাওলাদার বলেন, ‘বাইরে যে টাকা দেবো সেই টাকাটা শেফালীকেই দেই। চুল কাটা আর সেভ করলে ৫০ টাকা, আর শুধু শেভ করলে ২০ টাকা। শেফালী না থাকলে আমাদের ভান্ডারিয়া উপজেলায় গিয়ে চুল ও দাড়ি কাঁটাতে হতো। এখন আমরা গ্রামে বসেই এ কাজ করাতে পারছি।’

দোগনা গ্রামের যুবক রাসেল খান বলেন, ‘শেফালী কাকি মেসি, নেইমার, রোনালদো, রক স্টাইলে চুলের কাট দিতে পারেন। এছাড়াও অন্যকোনো কাটের ছবি দেখালেও তিনি সেই ধরনের কাট দিতে পারেন। অল্প টাকায় শেফালী কাকি আমাদের চুল কেটে দেন। আমরা তার কাছেই চুল কাটি।’

স্থানীয় অটোচালক রুবেল হাওলাদার বলেন, ‘আমরা শেফালী দিদির কাছেই চুল কাটি। তিনি আমাদের যত্নসহকারে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক কাট দেন। চুলও ভালো কাটেন এবং সেভও ভালো করেন। দোগনা গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই তার কাছে চুল-দাড়ি কাটে।’

শেফালী রানী শীল বলেন, ‘প্রথমে মানুষ হাসাহাসি করত যে মহিলা মানুষ পুরুষের চুল কাটে। তাছাড়া ধর্মীয় রীতিনীতি বাধা নিষেধ ছিল।’

‘গ্রামের বাজারে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হয়। হাটের দিন একটু কাজ বেশি হয়। আবার দুই এক দিন গ্রাহকই হয় না। তখন অবসর সময় বাজারে বিভিন্ন দোকানের ব্যবহৃত পানি এনে দেই। এতে একটু বাড়তি আয় হয়,’ যোগ করেন তিনি।

শেফালী ইউএনবিকে বলেন, ‘এখান থেকে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে পাঁচ ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চালাচ্ছি। এক মেয়ে বিএ পড়ে, অন্যরা স্কুলে পড়ালেখা করছে। একার আয়ে সংসার চলছে না।’

তিনি রানী আরও বলেন, ‘আমার নিজের কোনো জায়গা নেই, বাড়ির বারান্দায় আমাকে সেলুন করার স্থান দিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন নামে এক প্রবাসী। অন্যের জমিতে কোনো রকমে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছি। আমাকে একটি সেলুন ও বসতঘর তৈরি করে দিলে অন্তত বাকি জীবনটা ভালোভাবে চালিয়ে নিতে পারতাম।’

শেফালী রানীর মেয়ে বিথীকা শীল বলেন, ‘মাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। বাবার অবর্তমানে তিনিই আমাদের মানুষ করেছেন। নিজে অনেক পরিশ্রম করলেও আমাদের কোনো কাজ করতে দেননি। আমরা সরকারি চাকরি পেলে মাকে আর কোনো কাজ করতে দেবো না।’

ঝালকাঠির সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সহ সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন হিমু বলেন, ‘শেফালী রানীর মতো সাহসী নারীদের এগিয়ে নিতে প্রয়োজন সবার সহযোগিতা। সমাজের সব কাজেই এখন নারীরা পুরুষের সাথে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে, শেফালী রানী তার একটি বড় দৃষ্টান্ত।’ সূত্র: ইউএনবি।

সোনালীনউজ/এএস

Wordbridge School
Link copied!