• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২৩ বছর ধরে শিকলে বাঁধা আসলামের দুর্বিষহ জীবন


নওগাঁ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯, ০৩:৩৩ পিএম
২৩ বছর ধরে শিকলে বাঁধা আসলামের দুর্বিষহ জীবন

নওগাঁ : নওগাঁর রাণীনগরে প্রায় ২৩ বছর ধরে খোলা আকাশে ও বাড়ির বারান্দায় শিকলবন্দী জীবনযাপন করছেন উপজেলার মিরাট ইউপির হরিশপুর গ্রামের মুনি সাকিদারের ছেলে আসলাম হোসেন সাকিদার (৩৮)। মানসিক ভারসাম্যহীনতার অজুহাতে উপযুক্ত চিকিৎসা না করে তার পরিবারের লোকজন মিলে দিনের বেলায় বাড়ির পার্শ্বে একটি খেজুর গাছের সঙ্গে পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। রাতে তার জায়গা হয় বাড়ির বারান্দায়। পাঁচ বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে আসলাম সবার ছোট।

স্থানীয় হরিশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯১ সলে আতাইকুলা জনকল্যান উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াশুনার জন্য ভর্তি হলে সেখানে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা চলা অবস্থায় ১৯৯৫ সালে পরিবারের লোকজন আসলামের চলাফেরার গতিবিধিসহ নানা ধরণের মানসিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে। যার কারণে তার পিতা-মাতা চিকিৎসার জন্য এলাকার বিভিন্ন কবিরাজের দ্বারস্থ হয়ে অপচিকিৎসার কবলে পড়ে। তাকে ভুতে ধরেছে এমন অপবাদ দিয়ে কবিরাজরা আসলামের পিতা-মাতার কাছ থেকে চিকিৎসার নামে নানা প্রলোভনে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিয়মিত ঝাড়ফুঁক করতে থাকেন! কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। একপর্যায়ে আসলামের নানা ধরনের ভারসম্যহীনতার কারণে ও পারিবারিক নানান ধরণের অত্যাচারের একপর্যায় পরিবারের সদস্যরা তাকে হাত-পায়ে শিকল বন্দী করে রাখে।

চিকিৎসার জন্য নওগাঁ সদরের পার-নওগাঁ মহল্লার জনৈক বকুল রহমান নামের এক কথিত মানসিক ডাক্তারের স্মরণাপর্ন হন। সেখানে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তার বাড়িতে বন্দী রেখে প্রায় তিন বছর চিকিৎসা শেষে আসলাম কিছুটা সুস্থ হয় বলে চিকিৎসক দাবি করলেও ১৯৯৭ সালে চিকিৎসক তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে পরিবারের লোকজন তাকে হরিশপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে নিয়ে আসে। সে অন্য স্বাভাবিক মানুষের মতো চলাফেরা কাজ কর্ম করতে শুরু করলে পিতা মাতার ইচ্ছায় বছর খানেক পরেই উপজেলার আতাইকুলা গ্রামের মুনির উদ্দিনের মেয়ের সাথে আসলামকে বিয়ে দেয়। বিয়ের পর দাম্পত্ত জীবন হাসি খুশিতে চলা অবস্থায় তাদের ঘরে জন্ম নেয় শাওন নামের একটি পুত্র সন্তান যার বর্তমান বয়স ১০ বছর। এর কিছুদিন পরই যেন সব কিছুতেই এলোমেলো হয়ে যায় আসলামের জীবন। পরিবারের লোকজন আসলামের মধ্যে পূর্বের ন্যায় মানসিক পরিবর্তন আবারো লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে সে পুরাপুরি উন্মাদ হয়ে যায়।

মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষ থেকে আর্থিক অনাটনের কারণে দীর্ঘ মেয়াদী উপযুক্ত চিকিৎসা করতে না পারায় তার উন্মাদনা ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় বাবা-ভাই মিলে তাকে শিকলে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়।

শিকল বন্দী অবস্থায় প্রায় ২৩ বছর ধরে শিকলবন্দী জীবন যাপন করলেও পরিচিত জনেরা তাকে দেখতে গেলে সুন্দর ভাবে কথা বলে, ‘ভাই হামাক একটা বিড়ি দে? হামার জন্যে বিড়ি আনিচু। তাড়াতাড়ি দে বিড়ি খামু। পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক টাকা নষ্ট হলেও তার ভাগ্যে জোটেনি সঠিক চিকিৎসা সহায়তা। অথচ ঠিকমতো চিকিৎসা হলেই এ ধরনের রোগী ভালো হয় এমন অভিমত  মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের।

আসলামের বড় ভাই মেছের আলী, ভাবী শিউলী বেগম জানান, তাকে সুস্থ করতে পারিবারিক ভাবে আমরা সামর্থ অনুযায়ী অনেক টাকা খরচ করে বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করেছি, কিন্তু ভাইকে ভালো করতে পারিনি। তবে প্রতিবেশিরা অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতাল অথবা ঢাকাতে নিতে পারলে হয়তবা ভালো হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো ছোট পরিবারের পক্ষ থেকে টাকা খরচ করার সামর্থ না থাকায় আমার ছোট ভাইয়ের চিকিৎসার আশা ছেড়ে দিয়েছি। তার পাগলামিতে বিরক্ত ইতোমধ্যে তার স্ত্রী ছেলেকে রেখে বাবার বাড়িতে চলে গেছে।

রাণীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাঃ কেএইচএম ইফতেখারুল আলম খান বলেন, দেশে এই ধরণের রোগীদের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। বিশেষ করে পাবনা মানসিক হাসপাতাল কিংবা ঢাকায় নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে তার সুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এমএইউ/এএস

Wordbridge School
Link copied!