• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

২৮৭ তরুণীর সর্বনাশ করে শ্রীঘরে সেই ‘রয়েল’


সোনালীনিউজ ডেস্ক নভেম্বর ২২, ২০১৯, ০৯:৩০ এএম
২৮৭ তরুণীর সর্বনাশ করে শ্রীঘরে সেই ‘রয়েল’

ঢাকা : কখনো তিনি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এমডি; কখনোবা নামিদামি করপোরেট হাউসের জিএম। চলাফেরায় বেশ ধোপদুরস্ত; কথাবার্তায় ঝলকে উঠে হাই ক্লাস সোসাইটির ফুলঝুরি। আর এসব অভিজাত্যপূর্ণ নাম-ধাম-পোশাক ও চাল-চলনের নেপথ্য উদ্দেশ্যটি খুবই কুৎসিত। সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারীরা তার টার্গেট। কথার মোহে আকৃষ্ট করে তিনি তরুণীদের সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব করতেন। পরে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ।  তার নাম রাব্বী হোসেন চৌধুরী।  তবে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী ওই নাম হলেও তাঁর পরিচয়পত্রটি নকল; নিজের মতো করে বানানো হয়েছে।

দু-একজন নয়, এ পর্যন্ত ২৮৭ তরুণীকে সর্বস্বান্ত করেছেন তিনি।  এহেন পাপের পর পরিশুদ্ধ হতে সৌদি আরবেও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তার।  তবে তার আগে পাপকর্মের ঝোলাটি আরো ভারী করে নিতে চেয়েছিলেন; চেয়েছিলেন ৭০০ তরুণীকে ধর্ষণের পরই সৌদি আরবে যাবেন তিনি।

বিকৃত মানসিকতার মারাত্মক ধূর্ত এ রয়েল-চিটারের প্রকৃত নাম জাকির হোসেন বেপারি।  প্রতারণা করে বিয়ে; তারপর ভুক্তভোগীর সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত বছরের ৮ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়া এলাকার বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে দিনই ধর্ষণের অভিযোগে এক তরুণী মিরপুর মডেল থানায় জাকিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ সময় থানায় উপস্থিত ছিলেন, জাকিরের প্রতারণার শিকার আরও চার নারী। তারা সবাই চাকরিজীবী। পরবর্তী সময়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জাকির তার প্রতারণাকাণ্ডের  অনেক কিছুই ফাঁস করে দেন। তবে এরপর ওই মামলা থেকে জামিনে বের হয়ে ফের প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন জাকির।  মিথ্যা বিয়ের পর এক তরুণীর সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ফের শ্রীঘরের বাসিন্দা হয়েছেন এ প্রতারক। তার বিরুদ্ধে গত বুধবার রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলা করেছেন মণিপুরি পাড়ার একটি ছাত্রী হোস্টেলের ২৬ বছর বয়সী এক তরুণী।  অভিযোগের ভিত্তিতে সে দিনই জাকির ও তার সহযোগী জায়েদা আক্তার শাপলাকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানাপুলিশ।

গতকাল বৃহস্পতিবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই তৌফিক আহমেদ জাকিরের ৫ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত তার ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড না চাওয়ায় শাপলাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।

গত বছরের ২৫ নভেম্বর রয়েল-চিটার জাকিরের প্রতারণার বিষয়ে একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল গণমাধ্যমে।

জানা গেছে, প্রতারণার ফাঁদ পেতে তরুণীদের সর্বস্ব লুটে নিতে জাকিরের রয়েছে এক বিশাল সিন্ডিকেট। সংঘবদ্ধ ওই চক্রে রয়েছে নকল কাজী ও মৌলভি। এ ছাড়া চক্রের কিছু নারী-পুরুষ নিজের মা-বাবা ও ভাইবোন বানিয়ে জাকির তরুণীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে ভুক্তভোগীদের বুঝতেই দিতেন না কী ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হচ্ছে তাদের। এভাবে বিয়ের নামে গত দুই বছরে জাকির ২২ ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবী নারীকে ধর্ষণ করেছেন। এরপর অন্তরঙ্গ ছবি তুলে সেগুলো ইন্টারনেটে ছাড়ার হুমকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ।

সম্প্রতি ফেসবুকে বিয়ের নামে আরেকটি প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিলেন জাকির।  অবশ্য এবার তিনি নিজেই ফাঁদে পড়েন; আগেভাগেই প্রতারণার শিকার নারী বুঝে ফেলেন জাকিরের উদ্দেশ্য।

ওই তরুণী জানান, ফেসবুকের মাধ্যমে গত ৩১ অক্টোবর জাকিরের সঙ্গে তার পরিচয়।  এর পর ভুলিয়ে-ভালিয়ে তার সঙ্গে জাকির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন।  গত ৭ নভেম্বর নিজস্ব সিন্ডিকেটের হুজুর ডেকে তাকে বিয়েও করেন।  হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যান তিনি ওই তরুণীকে এবং তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেন বেশ কয়েকবার।  শুধু তাই নয়, নানা বিপদ বা সমস্যার কথা বলে জাকির ওই তরুণীর কাছ থেকে ইতোমধ্যেই প্রায় ৪৫ হাজার টাকাও হাতিয়ে নিয়েছেন।

জাকিরের প্রতারণার শিকার রাজধানীর গুলশান, উত্তরা, মিরপুর, বারিধারা, মালিবাগ, দক্ষিণখান, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী ১৭ ভুক্তভোগী তরুণীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে।  তারা প্রত্যেকেই জাকিরকে শনাক্ত করে তাকে প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।  ভুক্তভোগী তরুণীদের মাধ্যমে পাওয়া গেছে জাকিরের তিনটি বিয়ের কাবিনসহ তার প্রতারণায় ব্যবহৃত অসংখ্য ছবি, ফেসবুকের চ্যাটবক্সে কথোপকথনের স্ক্রিনশট ও ভিডিও ক্লিপ। পুলিশের কাছেও বিয়ের নামে প্রতারণার চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছেন জাকির।

এদিকে জাকিরের বিরুদ্ধে মিরপুর এলাকার ভুক্তভোগী যে তরুণী মামলা করেছেন, তিনি অভিযোগ করেন ওই প্রতারকের সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্নভাবে তাকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছেন।  না হলে তার মুখ অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়া হবে এবং অন্তরঙ্গ ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে।

ভুক্তভোগী তরুণীরা জানান, জাকিরের প্রতারণার শিকার সবার গল্প প্রায় একই রকম।  যেমন- জাকির প্রথমে বেছে নেন ব্যবসায়ী বা চাকরিজীবী নারী।  এরপর ফেসবুক অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে নিজেকে অবিবাহিত এবং প্রচুর টাকার মালিক ও প্রভাবশালী পরিচয় দিয়ে নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েন।  নানাভাবে বিয়ের জন্য রাজি হতে বাধ্য করেন।  একপর্যায়ে তার নির্ধারণ করা কোনো বাসায় নকল কাজী বা হুজুর ডেকে এনে পড়ানো হয় বিয়ে।  এরপর কৌশলে তাদের অন্তরঙ্গ ছবি তুলে রাখেন জাকির।  বিয়ের কয়েক সপ্তাহ পরই বেরিয়ে আসে তার আসল চেহারা।  বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মেয়ের সব টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে একপর্যায়ে সটকে পড়েন তিনি।  বন্ধ করে দেন সব ধরনের যোগাযোগ।  এরপর নতুন কোনো মেয়েকে একইভাবে বিয়ের ফাঁদে ফেলেন।  পরবর্তী সময়ে কোনোভাবে ভুক্তভোগীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে অস্বীকার করেন বিয়ের কথা।  ভুক্তভোগী কেউ প্রতিবাদী হলেই তার ব্যক্তিগত ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে ফের ব্লাকমেইল করা শুরু করেন।  সম্মান খোয়ানোর হুমকি দিয়ে তার কাছ থেকে আদায় করেন লাখ লাখ টাকা।  কথা না শোনায় ইতোমধ্যে কয়েকটি মেয়ের ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছেন জাকির।  তার বিয়ের ফাঁদে পড়ে এখন অনেক তরুণীরই জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে।  সামাজিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে অনেকের পরিবারও।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার এসআই তৌফিক আহমেদ জানান, জিজ্ঞাসাবাদে জাকির বিয়ের নামে অনেক নারীর সঙ্গে প্রতারণা করার কথা স্বীকার করেছেন। এসব কাণ্ডের তথ্যপ্রমাণও পাওয়া গেছে।  দুই দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছে পাওয়া তথ্যানুযায়ী এ চক্রে কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে, জানান এসআই তৌফিক।

সোনালীনিউজ/এএস

Wordbridge School
Link copied!