• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৪০ বছর ধরে কবর খনন করছেন এই নূর মোহাম্মদ


চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানুয়ারি ৬, ২০১৯, ০৫:২১ পিএম
৪০ বছর ধরে কবর খনন করছেন এই নূর মোহাম্মদ

নূর মোহাম্মদ

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : নূর মোহাম্মদ। বয়স ৮০ বছর। এলাকার মানুষ তাকে নুরু চাচা বলেই ডাকেন। কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই ৪০ বছর ধরে মৃত মানুষের জন্য কবর খনন করে চলেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার আজাইপুর মহল্লার বাসিন্দা এই নূর মোহাম্মদ। কারো মৃত্যুর খবর পেলেই ছুটে যান গোরস্থানে। কবর খনন থেকে শুরু করে দাফনের শেষ পর্যন্ত তিনি সহযোগিতা করেন।

নূর মোহাম্মদের সঙ্গে তার আজাইপুরের ছোট্ট বাড়িতে বসে কথা হলে তিনি জানান, দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। দিনমজুরি করে ৪ ছেলে ও ৪ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা করে রাজমিস্ত্রীর কাজ। সবাই এখন নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আর তিনি কখনো মাটি কাটা, কখনো দিনমজুর আবার কখনো রাজমিস্ত্রির কাজ করে রোজগার করেন। অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে টিন ও মাটির টালির ছাপড়া ছোট একটা ঘরে বসবাস করেন। বয়সের ভারে শরীরটা এখন দুর্বল হয়ে গেছে। আর তাই আগের মতো কাজ করতে পারেন না। তবে এখন পর্যন্ত কারো কাছে হাত পাতেননি বা কারো কাছে আর্থিক সহযোগিতা নেননি। নিজের রোজগারেই স্ত্রীকে নিয়ে সুখে আছেন বলে জানান নূর মোহাম্মদ।

তিনি আরও জানান, মাটি কাটার কাজ করার সুবাদে প্রথম দিকে মানুষ তাকে কবর খনন করার জন্য ডাকতো। তবে কবর খনন করে কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না তিনি। কবর খনন করা এখন তার ভালোলাগা ও মানসিক প্রশান্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো মানুষের মৃত্যুর খবর পেলেই সব কাজ ফেলে কোদাল হাতে ছুটে যান গোরস্থানের দিকে কবর খনন করতে।

নূর মোহাম্মদে জানান, এক সময় দিনে তিনটি কবরও খনন করেছেন। কিন্তু বার্ধক্যের কারণে এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না। প্রতিমাসে ৮ থেকে ১০ জন মৃতের জন্য কবর খনন করেন তিনি। সে হিসেবে সব মিলিয়ে প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার মৃতের কবর খনন করেছেন তিনি। গত ৪০ বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকেই মৃত মানুষের দাফনের জন্য এ কাজটি করে যাচ্ছেন। শুধু তার নিজের এলাকাতেই নয়, আশপাশের পাড়া মহল্লায় কেউ মারা গেলেই তিনি ছুটে যান। অনেক সময় মৃতের আত্মীয়-স্বজন তাকে ডেকে নিয়ে যায়।

এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার আজাইপুর মহল্লার সারোয়ার হোসেন বলেন, কারো মৃত্যুর খবর পেলেই ছুটে যান নুরু চাচা। কারো কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেন না। কোথাও কাজ করার সময় কোনো মানুষের মৃত্যুর খবর পেলে কাজ ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে যান কবর খননের জন্য। আর কবর খননের জন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিকও নেন না। কবর খননের কারিগর নুরু চাচা আমাদের এলাকার গর্ব এবং সকলের শ্রদ্ধারপাত্র।

নূর মোহাম্মদ বলেন, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী অথবা অপরিচিত যেই হোক না কেন মৃত্যুর খবর শোনা মাত্রই ছুটে যাই কবরস্থানে। নিয়ম অনুযায়ী কবর কেটে দিয়ে আসি। শুধু কবর নয় তার জানাজার নামাজেও শরীক হই। অনেক পরিবারের মানুষ কবর কাটার জন্য টাকা দিতে চাইলেও আমি সেটা নেই না। কারণ আমি মনে করি এটা একটা মহৎ ও ভালো কাজ। আমাকেও তো একদিন মরতে হবে। মাটির ঘর কবরে যেতে হবে সবাইকে। এ কাজটি করলে মন থেকে প্রশান্তি পেয়ে থাকি। তা ছাড়া আমি মনে করি মহান আল্লাহ এ কাজের জন্য হয়তো আমাকে ও আমার সকল পাপ কাজকে ক্ষমা করে দেবেন।

তিনি আরও বলেন, সমাজে মানুষের উপকারের জন্য নানা রকম কাজ মানুষ করে থাকে। আর আমি মৃত মানুষের জন্য স্বেচ্ছায় এ পেশাকেই বেছে নিয়েছি। যতদিন বেঁচে আছি মৃত মানুষকে দাফনের জন্য নিজ দায়িত্ব ভেবে এবং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্যই এই কাজ করে যাব।

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে নূর মোহাম্মদ বলেন, আমি এত মানুষের কবর খুঁড়লাম, জানি না আমার কবরটি কে খুঁড়বে?

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!