• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‍‍`ওরা আমাকে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতো‍‍`


সোনালীনিউজ ডেস্ক জুন ২১, ২০১৯, ০৭:৪৮ পিএম
‍‍`ওরা আমাকে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতো‍‍`

ঢাকা: "আমি যখন বড় হচ্ছিলাম আমার পুরুষের পোশাক পরতে ভালো লাগতো না। আমার বড় দুটো বোন ছিল আমি প্রায়ই ওদের ফ্রক পরতাম", বলছিলেন বাংলাদেশে হিজড়া সম্প্রদায়ের একজন নেত্রী অনন্যা বনিক।

"আমার পাশের বাসার কাকিমা বলতো তুইতো আসলে পোলা না মাইয়াও না। তাহলে তুই মনে হয় খোজা। তুই তো হিজড়া। আমি তখন আমার মাকে প্রশ্ন করেছিলাম আসলেই কি আমি হিজড়া? আমার মা তখন কোন উত্তর দিতে পারেননি।", বলছিলেন তিনি।

পরনে সাদা কালো রঙের শাড়ি, ঠোটে লিপস্টিক, চোখে গাঢ় করে লাগানো কাজল দিয়ে অনন্যা বনিক নিজেকে সাজিয়েছেন খুব যত্ন করে।

প্রাণবন্ত হাসিভরা মুখে এসে রাস্তা থেকে আমাকে নিজের একটি বিউটি পার্লার পর্যন্ত নিয়ে গেলেন তিনি। নিজের গল্প বললেন কোন প্রকার সংকোচ ছাড়া।

হিন্দু পরিবারে তার জন্ম। সেসময় পরিবার তার নাম দিয়েছিলো গৌতম বনিক। তবে তিনি নিজেকে গৌতম হিসেবে কখনোই মানতে পারেননি। মেয়েদের মতো হতে চেয়েছেন বলে পরিবার তাকে নিয়মিত শাস্তি দিতো।

তিনি বলছেন, "আমার দাদারা আমাকে নিয়মিত মারধোর করতো, কেন আমি ছেলেদের মতো সেজে থাকি। আমাকে জোর করে মাঠে খেলতে নিয়ে যেতো, সাইকেল চালানো শেখানোর চেষ্টা করতো। যাতে আমি পুরুষের মতো হয়ে উঠি"

তিনি বলেছেন , "গৌতম হিসেবে ওরা আমাকে পুরুষ তৈরি করতে চেয়েছে কিন্তু আমিতো পুরুষ না। শাস্তি হিসেবে আমাকে সাইকেলের চেইন দিয়ে পায়ে বেড়ি বানিয়ে তালা দিয়ে রাখা হতো। শুধু বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারতাম।"

কিন্তু একদিন নিজের মায়ের সাহায্য নিয়ে এই শিকল ছিঁড়ে একদিন বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে এলেন গৌতম। হয়ে উঠলেন অনন্যা বনিক।

তিনি বলছেন, "যখন আমি বুঝলাম এই পরিবার আমার জন্য না, যে গলিটাতে আমি বড় হয়েছি, যে গলির কাকিমা হিজড়া খেতাব আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছেন, সেই গলিটার সমাজটা আমার জন্য না। আমি সেই সমাজকে সেই পরিবারকে মুক্তি দিয়ে আমার কমিউনিটিতে চলে এসেছি।"

তার বাবা তাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে নাচের ওপরে ডিপ্লোমা রয়েছে তার।

আজ সেজন্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরপরই কিছুটা আর্থিক সঙ্গতি তার ছিল। সেটিই তাকে সাহস যুগিয়েছে।

কিন্তু প্রতিটা জায়গায় তাকে কিভাবে ধাক্কা খেতে হয়েছে সেই বর্ণনা দিয়ে অনন্যা বনিক বলছেন, "প্রত্যেকটা জায়গায় আমাকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। যেমন পাবলিক বাসে ওঠার সময় জিজ্ঞেস করে মালটাতো হিজড়া। কোন সিটে বসতে গেলে যাত্রীরা উঠে চলে যায়। বাস ড্রাইভার, রিকশাওয়ালা, বাড়িওয়ালা, পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া, মুদি দোকানদার, চাওয়ালা সবার কাছেই আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে পরীক্ষা দিতে হয়েছে।"

কিন্তু সেই পরীক্ষায় ব্যক্তি জীবনে বেশ সফল হয়েছেন অনন্যা বনিক। হিজড়াদের নিয়ে সরকারি নানা প্রকল্প ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বা আইসিডিডিআরবি'র জন্য কাজ করেছেন।

এলজিবিটি কমিউনিটির সংগঠন বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের যোগাযোগ কর্মকর্তা ছিলেন। এখন হিজড়াদের কল্যাণের জন্য নিজেই সাদাকালো নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন।

দুটি বিউটি পার্লার প্রতিষ্ঠা করেছেন যেখানে হিজড়া সম্প্রদায়ের অনেকে কাজ করেন ও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।

যে ভাইয়েরা একসময় তাকে নির্যাতন করতো এখন তারা যোগাযোগ করছেন। তিনি বলছেন, "এই অবস্থান তৈরি করতে আমাকে আঠারো বছর কাজ করতে হয়েছে।"

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী নারী বা পুরুষ নয়, হিজড়া হিসেবে পরিচিতি পাবেন।

কিন্তু তাতে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবন কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা জানতে চাইলে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।

কিন্তু তিনি বলছেন, "তাদের আমাদের সাথে বসতে হবে। আমরা কোন যায়গা থেকে কাজটা শুরু করবো। কোন কাজটা আমাদের জন্য ভালো হবে, কোন কাজটা আমাদের জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ হবে সেগুলো বুঝতে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের লোকদের আমাদের সাথে বসতে হবে। এখনই বললাম যাদুর লাঠি এটা করে দাও আর হয়ে গেলো সেরকম করেতো আর হবে না"

কিন্তু তার মতে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। তবে তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট এখনো পাচ্ছেন না তারা। তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ে সেটি চাইলেই ডাক্তারি পরীক্ষার দিকে তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

একই সাথে হিজড়াদের যে প্রথাগত পেশাগুলো ছিল সেগুলো এখন আর জনপ্রিয় নেই। বিয়ে বাড়িতে নাচ-গান বা নতুন জন্ম নেয়া শিশুকে আশীর্বাদ করার এই পেশাটি হারিয়ে হিজড়ারা ভিক্ষার দিকে ঝুঁকছেন।

বাড়ি-ঘর বা বাজারে গিয়ে টাকা ও নানা সামগ্রী নিচ্ছেন। রাস্তায় ট্রাফিক সিগনালে তাদের নিয়মিত গাড়ির জানালায় টাকা চাইতে দেখা যায়।

তাদের কিছুটা জোরালো আচরণের জন্য অনেকে ভয় পাচ্ছেন। কেউবা আবার ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। মূলধারার অনেকে বিষয়টিকে চাঁদাবাজি হিসেবেও উল্লেখ করে থাকেন।

সে প্রসঙ্গে অনন্যা বনিক বলছেন, "এটা আসলে বোঝাপড়ার একটা সমস্যা। সমাজ আমার জন্য কোন ব্যবস্থা করেনি। এখন পর্যন্ত সমাজে আমরা অবহেলিত। আমাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। এই ইন্টারনেটের যুগে আমাদের সেই নাচও কাউকে আর বিনোদন দেয়না। তখন আমি কি করবো? আমি মানুষের কাছে হাত পাতি"

অনন্যা বনিক বলছেন, "আমরা চুরি করছি না। পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা নিচ্ছি না। আমরা চেয়ে নিচ্ছি। লোকজন দেখছে দোকান থেকে হয়ত একটু চাল নিলাম বা দুটো আলু নিচ্ছি"

তিনি বলছেন এমন এক সমাজ একদিন হবে যেদিন তাকে এভাবে ভিক্ষা করতে হবে না।-বিবিসি বাংলা

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!