আগুনে দগ্ধ মায়ের পর চলে গেছেন ছেলে

২০ বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করা সহকর্মীর জন্য ভালোবাসা

  • রাজশাহী ব্যুরো: | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০২৩, ০৬:২৩ পিএম
২০ বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করা সহকর্মীর জন্য ভালোবাসা

রাজশাহী: রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় অগ্নিকাণ্ডে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন ও তার ছোট ছেলে রাফিউল বাসারের মৃত্যুতে শোক ও ভালোবাসার কথা জানিয়েছেন তাদের বন্ধু, স্বজন ও সহকর্মীরা। তারা বলেছেন, ফরিদা ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক আর তার সন্তান রাফিউল ছিলেন স্বল্পভাষী, শান্ত আর মিশুক প্রকৃতির একজন তরুণ।

ফরিদা ইয়াসমিন (৪৫) ছিলেন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার শিবপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। আর রাফিউল বাসার এবার উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছিলেন।

গত শুক্রবার ভোরে বাগমারায় তিনতলা একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হন তারা। ঘটনাস্থলেই ফরিদার মৃত্যু হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাফিউল মারা যান।

এলাকাবাসী বলেন, বাগমারা উপজেলার হাসনিপুর গ্রামের মাদারীগঞ্জ বাজারে অবস্থিত তিনতলা ভবনটি একসময় ছিল আশা সিনেমা হল। সিনেমা হলটি বন্ধ হওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দা ও দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মচারী এজাজুল সেটি কিনে নেন।

সিনেমা হলের তিনতলায় তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন। কয়েকজন ভাড়াটেও ছিলেন। তবে ঈদে তারা গ্রামের বাড়িতে গেছেন। ভবনের অধিকাংশ স্থান বিভিন্ন পণ্যের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অগ্নিকাণ্ডের সময় এজাজুল বাসায় ছিলেন না। তিনি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন।

স্বজন, প্রতিবেশী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতের খাবার খেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে তিনতলার বাসায় ঘুমিয়ে পড়েন স্কুলশিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন। ভোরে আগুন টের পেয়ে প্রতিবেশীরা চিৎকার শুরু করেন।

খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট এসে আগুন নেভায়। তিনতলার একটি কক্ষে ফরিদা ইয়াসমিনের পোড়া লাশ পাওয়া যায়। আগুন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে দুই ভাই রাশেদুল বাসার ও রাফিউল বাসার তিনতলা থেকে লাফ দেন। দগ্ধ দুই ভাইকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠানো হয়।

চিকিৎসাধীন রাশেদুল বাসারকে ছোট ভাই ও মায়ের মৃত্যুর খবর এখনো জানানো হয়নি বলে জানান তার চাচা রতন হোসেন।

ফরিদা ইয়াসমিন যে বিদ্যালয়ে চাকরি করতেন ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সে আমাদের খুব আপনজন ছিল। খুব সহজ ও দায়িত্বপরায়ণ ছিল ফরিদা ইয়াসমিন। এমন সহকর্মী পাওয়া দুরূহ। একজন আদর্শ শিক্ষকের যেসব গুণাবলি থাকা দরকার, তার সব কটিই ছিল তার ভেতরে। শুধু শিক্ষক-সহকর্মী নয়, ছাত্রীদেরও আপনজন ছিল সে।’

তিনি জানান, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্ত ছিল না। দীর্ঘ ২০ বছর বিনা বেতনে পাঠ দান করেছেন ফরিদা ইয়াসমিন। ২০১৯ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হয়। এর পর থেকে তিনি সরকারি বেতনের অংশ পেতেন।

সহকর্মী ও বন্ধু শিরিনা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তারা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন। একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুবাদে তাদের বন্ধুত্ব দৃঢ় হয়। নিজেদের মধ্যে কোনো দিন ভুল-বোঝাবুঝি হয়নি। তার কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিরিন।

রাফিউল বাসারের মৃত্যুতে বন্ধুরাও শোকার্ত। রাকিব নামের এক বন্ধু বলেন, ‘সে খুবই নম্র ছিল। কথাবার্তা কম বলত। গ্রামে এলে আমাদের সঙ্গে মিশত। লেখাপড়া নিয়ে আলাপ করত।’

রাফিউলের চাচা গ্রাম্য চিকিৎসক রতন হোসেন বলেন, ভাবি ও ভাতিজাকে এভাবে হারাবেন ভাবতে পারেননি। তাদের মৃত্যুতে পরিবারে যে শূন্যতা নেমে এল, তা কীভাবে পূরণ হবে এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

সোনালীনিউজ/আইএ

Link copied!