গারো পাহাড়ে আগুন, জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

  • শেরপুর প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০২৪, ০৬:৫৯ পিএম
গারো পাহাড়ে আগুন, জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

শেরপুর: সীমান্ত ঘেঁষা শেরপুরের ঝিনাইগাতীর কাংশা ইউনিয়নের গারো পাহাড়। এখানে শাল-গজারির বনের অন্তত ১০টি স্থানে গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এতে পাহাড়ি বনের গাছ-পালা ও প্রাণী ধ্বংসের পাশাপাশি নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুণ।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বনের জমি দখল আর লাকড়ি সংগ্রহ করতে অর্থলোভী দুর্বৃত্তরা এমন অপকর্ম করছে। প্রতি বছরই চলছে এভাবে বন পোড়ানোর মতো জঘন্য কাজ। এ মৌসুমে এলেই বনে আগুন দেওয়ার কারণে পুড়ে যায় ছোট গজারি গাছ, ঝোপঝাড়, লতাপাতা, পোকামাকড়, কেঁচো ও কীটপতঙ্গসহ বিভিন্ন প্রাণী। পোড়া মাটিতে যেহেতু বৃক্ষ জন্মাচ্ছে না তাই বিনষ্ট হচ্ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য এবং বিলুপ্ত হচ্ছে বন্য প্রাণী, কীটপতঙ্গ ও পাখি।

বন বিভাগের সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের আওতায় ৩টি বিট কার্যালয় রয়েছে। এসব কার্যালয়ের আওতায় বনভূমি রয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮৮০ একর যেখানে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষসমৃদ্ধ সবুজ বনানী রয়েছে। প্রতি বছরের ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে পড়ে। বনের ভেতর দিয়ে সড়কপথ থাকায় খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা বনে আগুন দেয়। শুকনো ঝরাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় মুহূর্তেই বনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন দেওয়ার সঙ্গে জড়িতরা বরাবরই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রতিবছরই চলছে বন পোড়ানোর এমন অপকর্ম।

সম্প্রতি ঝিনাইগাতী-কামালপুর সড়কের ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের গজনী বিট এলাকার গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের ছয়টি স্থানে আগুন জ্বলছে। স্থানীয়রা বলেন, কে বা কারা ঘণ্টাখানেক আগে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহে বনের কমপক্ষে ১৫টি স্থানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

ছোট গজনীর ডিবিশন সাংমা বলেন, বনের ভেতর অসংখ্য রাস্তা রয়েছে। কে কখন কোন রাস্তা দিয়ে এসে আগুন দিচ্ছে, তা বোঝার উপায় থেকে না। তবে কিছুদিন ধরে মাঝেমধ্যেই বনের ভেতর আগুনের দেখা মিলছে। যদিও বন বিভাগের লোকজন ও আমদের মতো সচেতন ব্যক্তিরা এসব আগুন নেভাতে চেষ্টা করি কিন্তু কে আগুন দিয়েছে তা শনাক্ত করা মুশকিল। 

রাংটিয়া এলাকার ‘আপন শিক্ষা পরিবার’র পরিচালক রহমত আলী বলেন, প্রতিবছর এ মৌসুমে বনে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। মাঝেমধ্যে বিট কার্যালয়ের আশপাশের বনেও আগুন জ্বলতে দেখি। এরপরও এসব বন্ধের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায় না বন বিভাগকে।

ভয়েজ অব ঝিনাইগাতীর সভাপতি জাহিদুল হক মনির বলেন, বনের মধ্যে প্রবেশ করা মৌয়ালী, বনজীবী, স্থানীয় বাসিন্দা ও দর্শনার্থীরা এখনও বনের মধ্যে অবাধে ধূমপান করে যাচ্ছেন। সিগারেটের আগুনেও এমন ঘটনা ঘটে। তাছাড়া দখলবাজদের একটা চক্রান্ত ত রয়েছেই। এজন্য বনবিভাগকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে এ বন তার সত্বা হারিয়ে ফেলবে।

বাংলাদেশ বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন নেটওয়ার্ক (বিবিসিএন)'র চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ বলেন, চোরা কারবারি, শিকারিদের অপতৎপরতা ও দখলবাজদের কারণে একাধিকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে গারো পাহাড়ের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ। বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্যরোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বাড়তে হবে। তিনি অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ৫টি সুপারিশ তুলে ধরেন। সুপারিশগুলো হলো, বন বিভাগের অফিসে অগ্নি নির্বাপন সরঞ্জামাদি মজুদ রাখা এবং অগ্নি নির্বাপনে দক্ষ বন কর্মকর্তা-কর্মচারী গড়ে তোলা। অগ্নিকাণ্ড প্রবণ এলাকায় প্রতি ১ কিলোমিটার পরপর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা করা, তিনটি রেঞ্জেই বনের মধ্যে প্রবেশের সময় দাহ্য পদার্থ (বিড়ি, সিগারেট, লাইটার, দিয়াশলাই) বহন নিষেধ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে স্থানীয় জন প্রতিনিধি, ইমাম, পুরোহিত, ফাদার, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে নিয়মিত সমাবেশ করা,  মাইকিং করে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির বিধান জানিয়ে দেওয়া। এ মৌসুমে বিশেষ দল গঠন করে সার্বক্ষণিক নজরদারির ব্যবস্থা করা। 

রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আবদুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান সময়ে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে পড়ে দুই-তিন ইঞ্চি উঁচু স্তর হয়ে যায়। এতে আগুন ধরিয়ে দিলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বনের ভেতর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের অল্প সংখ্যক স্টাফ নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। পাশাপাশি দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

এমএস

Link copied!