কোন পথে রিজার্ভ?

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২৩, ১১:৩৯ এএম
কোন পথে রিজার্ভ?

ঢাকা : বৈশ্বিক কারণে চাপে পড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি গত দেড় বছর ধরেই নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার সহায়তা দিয়ে চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আর তাতে করে ধারাবাহিকভাবে কমছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়। ২০২১ সালের অগাস্টে যেখানে রিজার্ভে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, এখন তা ২৫ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

অবশ্য এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব ‘গ্রস’ হিসাব। আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে ২৩ নভেম্বর দিন শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।

যে পরিমাণ ডলার বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোনো সময় চাহিদা মত ব্যবহার করতে পারবে, আইএমএফ এর হিসাবে সেটা হল প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ। গ্রস রিজার্ভ থেকে সব ধরনরে দায় বাদ দিয়ে নিট রিজার্ভ হিসাব করতে হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় বর্তমানে ৫০ মিলিয়ন ডলার, আইএমএফ এর ঋণ রয়েছে গত জুন পর্যন্ত তিন দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া ব্যাংকগুলোর বিদেশি মুদ্রা ক্লিয়ারিং (এফসি) হিসাবে লেনদেন নিস্পত্তির অপেক্ষায় আছে এক বিলিয়ন ডলার। এসব দায় বাদ দিতে বলেছে আইএমএফ।

আন্তর্জাতিক সংস্থাটির পরামর্শ মেনে এসব দায় বাদ দিলে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে।

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে রিজার্ভ কমতে থাকার এ প্রবণতা বজায় থাকলে আগামীতে অর্থনীতি কতটা চাপে পড়বে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অর্থনীবিদরাও।

আমদানি নিয়ন্ত্রণের চলমান উদ্যোগে বাণিজ্য ভারসাম্যের ঘাটতি কমে আসা এবং চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত দশাকে অর্থনীতির জন্য ‘স্বস্তিদায়ক’ হিসেবে দেখছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত। তবে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়াকে তিনি অর্থনীতির জন্য মাথাব্যথার কারণ বলে মনে করছেন।

তিনি বলেন, কারেন্ট অ্য্যাকাউন্ট (চলতি হিসাব) খুব একটা সিরিয়াস প্রবলেমে নেই। সমস্যা যেখানে, সেটা হচ্ছে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি। এটা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা কাজ করছে। বিদেশি সহায়তা এখন খুব একটা আসছে না। এ কারণে আর্থিক হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি কমে হয় ১ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ৭ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ছিল।

আর চলতি হিসাবে গত সেপ্টেম্বর শেষে উদ্বৃত্ত ছিল ৮৯ দশমিক ২০ কোটি ডলার, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার।

অন্যদিকে গত সেপ্টেম্বর শেষে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারে, যেখানে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ৮৩ দশমিক ৯ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

জায়েদ বখত বলেন, আর্থিক হিসাবে যদি উন্নতি হয়, তাহলে আশা করা যায় রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। নির্বাচনের পর সরকার স্থিতীশিল হলে প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হবে, যেগুলো এখন একটু ধীরে চলছে। তখন পাইপালাইনে থাকা বিদেশি ঋণ ও সহায়তা দ্রুত ছাড় হতে পারে।

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই আশাতেই আছে; ভাবছে যে আগামীতে বিদেশি মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল হবে। সেজন্যই ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৫০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব যদি ঠিক হয়, আর্থিক হিসাবের ঘাটতি যদি পূরণ হয়, বিদেশি সহায়তা আসতে শুরু করলে আমাদের কিন্তু ডলার পরিশোধের চেয়ে আসবে বেশি। তাহলে আগামী জানুয়ারির পর রিজার্ভ বাড়বে। কারণ আমাদের রেমিটেন্সও বাড়ছে।

কিন্তু বিদেশি সহায়তা যদি সেভাবে না আসে, নির্বাচন নিয়ে কোনো ইস্যু চলে আসে, তাহলে আমরা আরেকটু টাইট সিচুয়েশনে পড়ে যাব। সবকিছু নির্ভর করছে আর্থিক হিসাবের ওপর। আর্থিক হিসাবের অবনমনকে চিন্তার কারণ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংকও।

গত ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টের পূর্বের একটা স্বস্তিদায়ক উদ্বৃত্ত অবস্থা থেকে ঘাটতি পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে সার্বিক বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে এখনো কিছুটা ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, বিদেশি ঋণের দায় কমে যাওয়ায় আগামীতে রিজার্ভের ওপর চাপ আরো কমে আসবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বল্প মেয়াদী বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে তা নভেম্বরে ৬ দশমিক ৯ বিলিয়নে নেমেছে।

সামনের মাসগুলোতে স্বল্প মেয়াদী বিদেশি ঋণ পরিশোধের দায় আরো কমবে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক গত ২৩ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতি মাসে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ চার কোটি ৯০ লাখ ডলারে নেমে আসবে আশা করছি।

আইএমএফ এর হিসাবে স্বাভাবিক সময়ে একটি দেশের ৩ থেকে ৫ মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলে তা স্বস্তিদায়ক হিসেবে ধরা হয়।

২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ব্যয় ছিল ৬৯৬ কোটি ৮৪ লাখ ডলার, ২০২৩ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে তা ৫৩০ কোটি ৩১ লাখ ডলার হয়।

মহামারী পরবর্তী ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি মাসে গড় আমদানি ব্যয় ছিল ৬৮৭ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। আমদানি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা ব্যয়ের হিসাব ধরলে, গড়ে প্রতি মাসে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি দায় সৃষ্টি হলে, বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে চার মাসের ব্যয় মেটানো যাবে। আর আইএমএফ এর হিসাবে তা দিয়ে তিন মাসের দায় মেটানো সম্ভব।

রিজার্ভ বাড়িয়ে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি সহায়তা ও ঋণ দ্রুত ছাড় করানোর চেষ্টাই এখন ‘সবচেয়ে সহজ পথ’ বলে মনে করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, বিদেশি মুদ্রা দ্রুত বাড়ানো যেতে পারে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়িয়ে। এতে কোনো খরচ নেই। কিন্তু বিনিময় হার বাজারমুখী না হওয়া পর্যন্ত এ খাতে খুব একটা আর বাড়ানো যাবে বলে মনে হয় না।

সহজ পন্থা হল পাইপলাইনে থাকা বিদেশি সহায়তা ছাড় করা। কারণ এখানে তো চুক্তি করাই আছে। এখন শুধু ছাড় করিয়ে নেওয়া।’

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বলেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে খুব একটা যে সফলতা পাওয়া যাবে-তা নয়। বিদেশিক মুদ্রা প্রবাহ দ্রুত বাড়ানোর যেসব সুযোগ বাংলাদেশের সামনে রয়েছে, সেদিকে যেতে হবে।

ডলারের বিনিময় হার বাজারমুখী করা এবং বাজারকে তার মত করে চলতে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সূত্র : বিডিনিউজ

এমটিআই

Link copied!