‘প্রবাসীরাই আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করেছে শক্ত ভিত্তির ওপর’

  • অর্থনীতি রিপোর্ট | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০১৬, ১১:৪৬ এএম
‘প্রবাসীরাই আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করেছে শক্ত ভিত্তির ওপর’

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেছেন প্রবাসীদের আয় জাতীয় উন্নয়নের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করছে। তাই বিমানবন্দর কিংবা দূতাবাসের কোথাও যেন তাঁরা হয়রানির শিকার না হন। গতকাল (১৮ ডিসেম্বর) শনিবার আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। 

মন্ত্রী বলেন, দূতাবাসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিমানবন্দরও আমাদের এখতিয়ারে নয়। তারপরও আমরা সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি কোথাও যেন প্রবাসীরা হয়রানির শিকার না হন। এ জন্য প্রয়োজনে নজরদারি করা হবে। দেশে তাঁদের সম্পদ বা বাড়িঘর দখল হয়ে যাচ্ছে, এমন অভিযোগ পেলেও আমরা ব্যবস্থা নেব।

বাংলাদেশ এখন আর বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল কোনো দেশ নয়। সারা বিশ্ব মিলে বাংলাদেশকে এখন যে পরিমাণ ঋণ বা অনুদান দিচ্ছে, তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) চেয়ে এই অর্থ ছয় থেকে দশ গুণ পর্যন্ত বেশি। কিন্তু এর পরও প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে দূতাবাস সবখানেই পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, এই অর্থবছরে বিদেশি ঋণ এসেছে ৩৪৪ কোটি ডলারের। অর্থাৎ ঋণের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। আবার বছর হিসেবে ধরলে ২০১৫ সালে যেখানে ২২৪ কোটি ডলার এফডিআই এসেছে, সেখানে ওই বছর প্রবাসী আয় এসেছে এক হাজার ৫২৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ ছয় গুণ বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। ২০১৪ সালের প্রবাসী আয় ছিল বৈদেশিক বিনিয়োগের দশ গুণ। সরকারি-বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতিবছর যে প্রবাসী আয় আসছে, সেটি মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ১৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ।

অভিবাসনবিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রবাসীরা বলছেন, যে প্রবাসীরা এত কষ্ট করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করছে না রাষ্ট্র। কোনো কাজে দূতাবাসগুলোতে গেলে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয় না- এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিদেশে যাওয়ার আগে পাসপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল এবং প্রতারক এজেন্সি, অতিরিক্ত খরচসহ সব ক্ষেত্রে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে প্রতিবছর তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার প্রবাসী দেশে ফেরেন লাশ হয়ে। তবে এত কিছুর মধ্যেও বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৬৯টি দেশে যাচ্ছেন প্রবাসীরা। 

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে চলতি বছরের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ১৬৯টি দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি চাকরি নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে চলতি বছরই গেছেন সাত লাখ ২২ হাজার। তাদের হাত ধরেই আসছে প্রবাসী আয়।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিবেচনায় নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আমাদের এখন আর বিদেশেদের ঋণের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। বরং বিদেশি ঋণের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি অর্থ আমাদের প্রবাসীরাই পাঠান। প্রবাসী আয়ের কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করেছে শক্ত ভিত্তির ওপর।’ প্রবাসীদের কল্যাণে রাষ্ট্র কী করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি, কোথাও যেন প্রবাসীরা হয়রানির শিকার না হন। এ জন্য প্রয়োজনে নজরদারি করা হবে। দেশে তাদের সম্পদ বা বাড়িঘর দখল হয়ে যাচ্ছে- এমন অভিযোগ পেলেও আমরা ব্যবস্থা নেব।’
অভিবাসীবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘যে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন, তাদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্রকে আন্তরিক হতে হবে। আবার অনেক সমস্যা আছে, যেগুলো একা বাংলাদেশ সমাধান করতে পারবে না। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে হবে।’

মধ্যপ্রাচ্যেই কর্মস্থান, সেখান থেকেই বেশি আয় : এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে যত লোকের বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে, তার মধ্যে ৭৫ শতাংশেরই কর্মসংস্থান হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে প্রায় আট লাখ লোক মালয়েশিয়া ও সাড়ে ছয় লাখ লোক সিঙ্গাপুরে গেছেন।

বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ছয় হাজার ৮৭ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। সে বছর রেমিট্যান্স এসেছিল ৩৫ কোটি টাকা। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো প্রবাসী আয় ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। ছয় বছর ধরে প্রতিবছর এক থেকে দেড় হাজার কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসছে।

২০০৯-১০ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য থেকেই সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আসা এক হাজার ৪৩৯ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে ২৯৫ কোটি ডলারই এসেছে সৌদি আরব থেকে। তালিকায় থাকা পরের দেশগুলো হলো- সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ওমান, যুক্তরাজ্য, বাহরাইন, কাতার ও সিঙ্গাপুর।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের দেশের তালিকায় বাংলাদেশ পৃথিবীর সপ্তম। বাংলাদেশের আগে আছে ভারত, চীন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, ফ্রান্স ও জার্মানি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই

Link copied!