ঘুরে আসুন রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি

  • নাসরিন জাহান জয়া, বেরোবি (রংপুর) | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ৫, ২০১৭, ০২:২৮ পিএম
ঘুরে আসুন রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি

তাজহাট জমিদার বাড়ি, রংপুর

রংপুর: বন্ধু-বান্ধব সবাইকে নিয়ে ঘুরতে, অবসরে পরিবারের সবাই বা প্রিয়জনকে নিয়ে আনন্দময় কিছু সময় কাটানোর জন্যই হোক, নিরিবিলি ও সাজানো-গোছানো জায়গা সবারই পছন্দ। এরকমই একটি জায়গা রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়ি। এটি যে শুধু বিনোদন কেন্দ্র, তা কিন্তু নয়। নিরিবিলি সাজানো-গোছানো পরিবেশের সাথে এখানে এসে যুক্ত হয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য। মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছে বহু প্রাচীন সময়ের মিলবন্ধনের নানা নিদর্শন।

রংপুরের অন্যতম উৎকৃষ্ট এই জায়গায় শুধু যে মানুষ অবসরে কিছুটা আনন্দময় মুহূর্ত কাটানোর জন্য ঘুরতে যায় তা নয়। ইতিহাস যাদের পছন্দের বিষয়, অতীতকে দেখতে ও জানতে যাদের ভাল লাগে, জ্ঞান অর্জনের জন্য যাদের হৃদয় উৎসুক হয়ে থাকে তাদের জন্যও আদর্শ একটি স্থান। রংপুর শহরে যেসব ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে, তাজহাট জমিদার বাড়ি তার অন্যতম। সাড়ে ষোল একরের ইংরেজির 'ইউ' আকৃতির বিশাল এলাকা জুড়ে এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি। 

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রংপুর জেলার তাজহাট, ডিমলা, কাকিনা, মহুনা, পীরগঞ্জ, বর্ধনকুঠি এলাকায় বেশ কিছু এলাকা এই জমিদারই অংশ ছিলো। আর তাদের বংশধরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো। তাদের ছিল বিশাল বিশাল আয়তনের প্রাসাদ। যেসবের মাঝে তাজহাট জমিদার বাড়ি অত্যধিক বিখ্যাত। শিখ ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত মান্নালাল রায় ছিলেন তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পাঞ্জাব থেকে এদেশে আসেন এবং রংপুরের মাহিগঞ্জ- এ বসবাস শুরু করেন। সে সময় মাহিগঞ্জ ছিল রংপুরের জেলা সদর। মান্নালাল রায় ছিলেন স্বর্ণকার। ধারনা করা হয়, মান্নালাল রায়ের আকর্ষণীয় 'তাজ' বা রত্নখচিত মুকুটের কারণে এই এলাকার নামকরণ করা হয় তাজহাট।

 

মান্নালাল রায় তার জীবদ্দশায় অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। তিনি ক্রমশ রংপুরের বিভিন্ন জায়গা নিজের কবজায় আনেন এবং আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন। মান্নালাল রায়ের নাতি ধনপত রায় বিয়ে করেন নয়া দুমকার রতন লাল রায়ের নাতনী কে। রতন লাল রায় পাঞ্জাব থেকে অভিবাসন গ্রহন করেন। ধনপত রায়ের নাতি উপেন্দ্রলাল রায় অল্প বয়সে মারা যাবার কারণে জমিদারির দায়িত্ব তার কাকা 'মুনসেফ' গিরিধারি লাল রায়ের হাতে এসে পরে। নিঃসন্তান হবার কারণে তিনি জনৈক গোবিন্দ দাসকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। গোবিন্দলাল ১৮৭৯ সালে এই জমিদারীর উত্তরাধিকারী হন। তিনি ছিলেন খুবই স্বাধীনচেতা এবং জনপ্রিয়। ফলে তিনি ১৮৮৫ সালে 'রাজা' এবং ১৮৯৬ সালে 'মহারাজা' উপাধি গ্রহণ করেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে নিজ বাড়ির ধ্বংশস্তুপের নিচে তার মৃত্যু হয়। ১৯০৮ সালে মহারাজা কুমার গোপাল রায় জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। 

তাজহাট জমিদার বাড়ির প্রাসাদটি রংপুর শহর থেকে ৩ কি.মি. দক্ষিন-পূর্বে অবস্থিত। পূর্বমূখী দোতলা এই বিশাল প্রাসাদটির দৈর্ঘ্য ৭৬.২০ মি.। বিদেশ থেকে আনা সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী ১৫.২৪ মি. প্রশস্ত কেন্দ্রীয় সিঁড়িটি সরাসরি দোতলায় চলে গিয়েছে। সেমি করিন্থীয় স্তম্ভ দ্বারা সমর্থিত আটকোনা বিশিষ্ট ড্রামির ওপর স্থাপিত গম্বুজটি প্রাসাদের মাঝ বরাবর ছাদের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সিঁড়ির উভয় পাশে দোতলা পর্যন্ত ইটালিয় মার্বেলের ধ্রুপদি রোমান দেব-দেবীর মূর্তি দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। সেগুলো অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে। 

প্রাসাদের সম্মুখভাগের দু’প্রান্ত সেমি আটকোনা বিশিষ্ট উদগত ও মধ্যভাগে একটি ৯-১৪ মি. উদগত বারান্দা রয়েছে। উক্ত বারান্দার ছাদের উপর চারটি সুসজ্জিত করিন্থিয় স্তম্ভ ও দু’পাশের উদগত অংশের প্রত্যেকটিতে দুটি করে একই ধরণের স্তম্ভ রয়েছে। যার উপর ত্রিকোনাকৃতির চালবিশিষ্ট দুটি কক্ষ রয়েছে। প্রাসাদটির নিচতলায় প্রবেশ পথের পিছনে ২৮.২৯ মি.-১৩.৭২ মি. মাপের হলঘর রয়েছে। প্রাসাদের অভ্যন্তরে পুরোভাগ জুরেই আছে ৩ মি. প্রশস্ত বারান্দা।

তাছাড়া উপরতলায় উঠার জন্য প্রাসাদে কাঠের দুটি সিঁড়ি রয়েছে। এ প্রাসাদে মোট ২২টি কক্ষ রয়েছে। ধারণা করা হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল রায় এটি নির্মাণ করেন। ১৮৮৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভবনটি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হত। ১৯৯৫ সালে প্রত্নতত্ত অধিদপ্তর ইমারতটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। ২০০২ সালে এটিকে বাংলাদেশ সরকার রংপুর জাদুঘরে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২০০৫ সাল থেকে রংপুর জাদুঘর হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়।

সোনালীনিউজ ডটকম/ঢাকা/এআই

Link copied!