করোনায় বিপর্যস্ত ভারত

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২১, ০২:৪০ পিএম
করোনায় বিপর্যস্ত ভারত

ঢাকা : করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত ভারত। দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। দেশটিতে প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। হাসপাতালগুলো ও চিকিৎসকরা বাইরে জরুরি নোটিশ টাঙিয়েছেন। তারা রোগীর ভিড় আর সামলাতে পারছেন না বলে জানিয়ে দিচ্ছেন। অক্সিজেনের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যেই দেশটিতে বিধানসভা নির্বাচনে ভোট গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। এতে করোনা ব্যাপক হারে ছড়াচ্ছে। গতকাল মাদ্রাজ হাইহোর্ট দেশটিতে এত মানুষের মৃত্যুর জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেছে। বলেছে, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হওয়া উচিত। দেশটিতে গতকাল ফের দৈনিক সংক্রমণের নতুন বিশ্ব রেকর্ড হয়েছে। সংকট সামাল দিতে ভারতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জার্মানিসহ বিশ্বের অনেক দেশই জরুরি চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। খবর : আনন্দবাজার পত্রিকা, এনডিটিভি ও বিবিসির।

গতকাল সোমবার সকালে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় তিন লাখ ৫২ হাজার ৯৯১ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে শনাক্ত রোগীর মোট সংখ্যা এক কোটি ৭৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। একই সময় মৃত্যুর সংখ্যায়ও নতুন রেকর্ড হয়েছে। করোনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৮১২ জন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ৯৫ হাজার ১২৩ জনে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে টানা পাঁচ দিন ধরে দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের বিশ্বরেকর্ড হয়েছে। হাসপাতালগুলো রোগীতে উপচে পড়ছে। শয্যা খালি না থাকায় অনেক গুরুতর রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে মহামারী পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অক্সিজেন সংকট। ইতিমধ্যেই অনেক রোগীর মৃত্যু হয়েছে অক্সিজেনের অভাবে। রাজধানী দিল্লির নামকরা হাসপাতালগুলোও অক্সিজেন সংকটের মধ্যে নতুন রোগী ভর্তি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে সংকট সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জার্মানি জরুরি চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। ভারতের সংকট কাটাতে ৩০০টিরও বেশি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই যন্ত্রটি বাতাস থেকে অক্সিজেন পৃথক করতে সক্ষম। কনসেনট্রেটরগুলো নিয়ে রোববার এয়ার ইন্ডিয়ার একটি কার্গো প্লেন নিউইয়র্ক থেকে রওনা দেয় এবং গতকাল সোমবার দুপুরে দিল্লি পৌঁছায়। অক্সিজেন সহায়তার পাশাপাশি ভারতে করোনার টিকা তৈরির কাঁচামাল রপ্তানিও ফের শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

রোববার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, ব্যাপক সংক্রমণ মোকাবিলায় ভারতকে সাহায্য করতে তার দেশ অবিলম্বে টিকার কাঁচামাল, চিকিৎসা উপকরণ ও সুরক্ষাসামগ্রী পাঠাচ্ছে। ব্রিটেন বলেছে, তারা ভারতে ৪৯৫টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, ১২০টি ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর এবং ২০টি ম্যানুয়াল ভেন্টিলেটর পাঠাবে। ফ্রান্স ঘোষণা দিয়েছে, তারা ভারতকে অক্সিজেন সহায়তা দেবে। দেশটিকে সৌদি আরব দেবে ৮০ টন তরল অক্সিজেন।

ইউরোপীয় কমিশন জানিয়েছে, তারা ভারতে অক্সিজেন এবং ওষুধ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। কমিশনের প্রধান ভন ডার লিয়েন বলেছেন, ভারতের সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিতে দ্রুত সংস্থানের ব্যবস্থা করছেন তারা। বিপদের সময় পুরনো শত্রুতা ভুলে ভারতের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে পাকিস্তানও। তারা প্রতিবেশীদের কাছে জরুরি চিকিৎসা উপকরণ পাঠাতে চেয়েছে। পাকিস্তানের ইধি ফাউন্ডেশন ভারতে ৫০টি অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে। নীতিনির্ধারকদের অবাস্তব সিদ্ধান্ত একটা দেশের পরিস্থিতি কত ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে তা ভারতের করোনা সংক্রমণের সংখ্যার দিকে তাকালে বোঝা যায়। করোনার বিরুদ্ধে বিজয় উল্লাস প্রকাশের দুই মাসের মধ্যেই মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারত। করোনা নিয়ন্ত্রণে দম্ভ প্রকাশ করেছিল দেশটির নেতারা। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে দৈনিক আক্রান্তের গড় ১০ হাজারের অঙ্ক ছাড়িয়ে এপ্রিলে এসে লাফিয়ে সেটা সাড়ে তিন লাখ পেরিয়ে গেছে। দেশটিতে সংক্রমণ বাড়ার পেছনে মোটা দাগে তিনটি বিষয়কে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো-নির্বাচনি প্রচার, ক্রিকেট ম্যাচ এবং কুম্ভ মেলা।

মার্চের শুরুতেই ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন কোভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে শেষ খেলা চলছে বলে ঘোষণা করেন। তার এমন আশাবাদ খতিয়ে দেখা যায়, গত বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দৈনিক আক্রান্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার। পরের মাসগুলোতে তা কমে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি হয় দিনে ১১ হাজার। তখন সপ্তাহে গড় মৃত্যু ছিল একশরও নিচে।

গত বছরের শেষদিকে দেশটির রাজনৈতিক নেতা, নীতিনির্ধারক এবং গণমাধ্যমের একটা অংশ ধরেই নিয়েছিল করোনা মহামারী থেকে বেরিয়ে এসেছে ভারত। ডিসেম্বরে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, কোভিড সংক্রমণের ঢেউকে অবনমিত করছে ভারত। এমনকি কাব্য করে বলা হয়, শীতের দীর্ঘায়িত ছায়া ছিন্ন করে সূর্যালোকের পথে অর্থনীতি।

ফেব্রুয়ারির শেষে ভারতের নির্বাচন কমিশন পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণা করে। এই নির্বাচনে ৮২৪টি আসনে ভোটার সংখ্যা ১৮ কোটি ৬০ লাখ। ২৭ মার্চ শুরু হয়ে এক মাসের এই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে এখনো ভোট চলছে। কোনো ধরনের সতর্কতা ও সামাজিক দূরত্ব না মেনে এ সময় পূর্ণ মাত্রায় নির্বাচনি প্রচার শুরু হয়। দিনর পর দিন  নিয়মিত জনসভা করে গেছেন রাজনৈতিক নেতারা। হাজারো মানুষের জমায়েতে হাতে গোনা কয়েকজনের মুখেই মাস্ক দেখা গেছে সেখানে। এবার কোভিডে এত মানুষের মৃত্যুর জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেছেন মাদ্রাজ হাইকোর্ট।  বিধিনিষেধ মানা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা দেখাতে না পারলে আগামী ২ মে ভোট গণনা আটকে দেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আদালত। ২ মে তামিলনাড়ুর কারুর কেন্দ্রে ভোটগণনা। কিন্তু সম্প্রতি ভোটগ্রহণ চলাকালে যে বিশৃঙ্খলার ছবি সামনে এসেছে, ভোটগণনার সময় যাতে তেমন পরিস্থিতি দেখা না দেয়, তার জন্য কোভিড বিধি মেনে গণনার ব্যবস্থা করার আর্জি জানিয়ে আদালতে জনস্বার্থ মামলা জমা পড়েছিল। গতকাল মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিচারপতি সেন্থিল কুমার রামমূর্তির ডিভিশন বেঞ্চে মামলার শুনানি শুরু হলে নির্বাচন কমিশনকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন উভয় বিচারক। বলেন, মহামারী আবহে রাজনীতিকরা বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করলেও নির্বাচন কমিশন কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।

কমিশনকে ভর্ৎসনা করে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আজকের এই পরিস্থিতির জন্য আপনারাই দায়ী। আদালতের নির্দেশ অমান্য করে রাজনীতিকরা জনসভা করেছেন। পদযাত্রায় বেরিয়েছেন। তা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হওয়া উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অথচ দুঃখের বিষয় যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকেই এই গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। বেঁচে থাকলে তবেই তো গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে পারবেন মানুষ! কেন রাজনীতিকদের জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হলো, তা নিয়ে কমিশনকে একহাত নেন বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি, তাতে বেঁচে থাকা এবং নিরাপদে থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাকি সবকিছু পরের বিষয়। যখন একের পর এক সভা হচ্ছিল, তখন কি আপনারা অন্য কোনো গ্রহে ছিলেন?

বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল দেশ ভারত করোনা সংক্রমণে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। আর মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও মেক্সিকোর পর চতুর্থ স্থানে আছে। তবে দেশটিতে করোনা মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে বলে ধারণা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। এদিকে মহামারী থেকে বাঁচতে ভারত ছেড়েছেন দেশটির অনেক ধনী ব্যক্তি। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের আগ মুহূর্তে আকাশপথে পরিবারসহ সম্পদশালী ব্যক্তিদের দেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ে। নিয়মিত ফ্লাইট ছাড়াও ব্যক্তিগত বিমান ও বিশেষ ফ্লাইটে করে দেশ ছাড়েন তারা। বিজনেস ইনসাইডার ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ধনীদের অধিকাংশের গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ব্রিটেন।

এর আগে আরব আমিরাত সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, দেশটিতে ভারত থেকে আসা সব ধরনের ফ্লাইট ২৫ এপ্রিল থেকে ১০ দিনের জন্যে স্থগিত করা হবে। ভারতের চার্টার কোম্পানি এয়ার চার্টার সার্ভিস ইন্ডিয়ার এক মুখপাত্র বলেন, বিশেষ চার্টার ফ্লাইট ও ব্যক্তিগত বিমানে চেপে দেশ ছাড়ার জন্যে ভারতের ধনীরা রীতিমতো উন্মাদ হয়ে উঠেছেন। দুবাইতে গত শনিবার আমাদের ১২টি ফ্লাইট ছিল। প্রত্যেকটি ফ্লাইটের সবগুলো আসন ছিল যাত্রীতে ঠাসা। এমন ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা মেটাতে আমরা ১৩ আসন ও ছয় আসনের ছোট দুটি বিমান ৫১ কোটি ৬০ লাখ রুপিতে ভাড়া করি। মুম্বাই থেকে দুবাইগামী এমন দুটি বিমানে আসন পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন ভারতীয় ধনীরা। গত ২৪ ঘণ্টায় ভারত থেকে কমপক্ষে ১২টি বিশেষ ফ্লাইট ব্রিটেন গেছে। ব্রিটেন পাড়ি দিতে যাত্রীদের গুনতে হয়েছে ১০ কোটি ৩২ লাখ রুপির বেশি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!