সোমালি জলদস্যুদের দলে শিশু-কিশোররা

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৪, ১০:৪৪ এএম
সোমালি জলদস্যুদের দলে শিশু-কিশোররা

ঢাকা : আরেক বাংলাদেশি জাহাজ এমভি জাহান মণি ১৪ বছর আগে যখন সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল সেটিতে জিম্মি নাবিকদের যারা পাহারা দিতেন তাদের মধ্যে ছিলেন ১৬-১৮ বছর বয়সী সশস্ত্র কিশোররা। দীর্ঘ এ সময় পরও সাগরে দস্যুতার কাজে অল্প বয়সীদের যুক্ত থাকার প্রবণতা কমেনি।

সবশেষ ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে আটকের সময় সোমালি জলদস্যুদের ব্যবহার করা আরেক জাহাজ এমভি রুয়েনের জলদস্যুদের মধ্যেও রয়েছেন শিশু-কিশোররা।

ভারতীয় নৌবাহিনীর ৪০ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানে উদ্ধার এমভি রুয়েনে আটক ৩৫ সোমালি জলদস্যুদের এক চতুর্থাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক। সাগরে গ্রেপ্তারের পর তাদের ভারতের একটি আদালতে তোলা হলে জানা যায় এ তথ্য।

এতে করে সোমালিয়া উপকূলে ‘সমুদ্রপথের আতঙ্ক’ হিসেবে পরিচিত সশস্ত্র জলদস্যুদের দলগুলোতে শিশু-কিশোরদের থাকার বিষয়টি আবারও সামনে আসে।

এর আগেও বিভিন্ন সময় জাহাজ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ধরা পড়াদের মধ্যে শিশু-কিশোরদের দস্যুতায় জড়িত থাকার এমন তথ্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

মাল্টার পতাকাবাহী এমভি রুয়েন থেকে গ্রেপ্তার জলদস্যুদের রোববার ভারতের আদালতে হাজির করা হলে তাদের মধ্যে আটজনের দাবি তাদের বয়স ১৮ বছরের কম। এমন সংবাদ দিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

শুধু এখন নয়, বছরের পর বছর ধরে সোমালি জলদস্যুদের দলগুলোতে শিশু-কিশোরদের থাকার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

ফ্লোরিডাভিত্তিক সামুদ্রিক শিল্প বিষয়ক প্রকাশনা দ্যা মেরিটাইম এক্সিকিউটিভ ২০১৭ সালের মে মাসে ‘চিলড্রেন ইফেক্টেড বাই মেরিটাইম পাইরেসি: এ হ্যান্ডবুক ফর মেরিটাইম সিকিউরিটি সেক্টর এক্টরস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

এতে ২০১৪ সালে সোমালিয়া উপকূলে গ্রেপ্তার হওয়া জলদস্যুদের মধ্যে ২০ শতাংশের বয়স ছিল ১৮ বছরের কম ছিল বলে তথ্য দেওয়া হয়।

২০১৭ সালের পর বেশ কিছুদিন সোমালি উপকূলে জলদস্যুতা তুলনামূলক কম ছিল। এরপর আবার গত বছরের নভেম্বর থেকে আবার সোমালিয়া সংলগ্ন ভারত মহাসাগর, এডেন উপসাগর এবং হর্ন অব আফ্রিকা অংশ ঘিরে জলদস্যুরা সক্রিয় হয়ে উঠে।

এর আগের তথ্যে দেখা যায়, ২০১১ সালের ১৭ মার্চ ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদন বলছে-ওই সপ্তাহে আরব সাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে গুলি বিনিময়ের পর আটক ৬১ সোমালীয় জলদস্যুর মধ্যে ২৫ জনই ছিল শিশু, যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে। এমনকি তাদের মধ্যে ৪ জনের বয়স মাত্র ১১ বছরের কিছু কমবেশি ছিল।

২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক সভার প্রতিবেদনেও বলা হয়- জাতিসংঘের চিলড্রেন অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্ট বিষয়ক দূত মুক্তিপণের জন্য জাহাজ জিম্মি করার কাজে শিশুদের ব্যবহার বাড়ার কথা বলেছিলেন।

শিশুরা কেন : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্ব রাজনীতি বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম দ্যা জিওপলিটিক্স এ ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে, জার্মানিতে বিচারের মুখোমুখি হওয়া ১৮ বছর বয়সী এক সোমালি জলদস্যুর তথ্য প্রকাশ করা হয়।

মো. ইউসুফ নামে জলদস্যু দলের ওই সদস্য বলেন, দস্যুতার কাজে যোগ দেয়ার আগে তিনি নৈশ প্রহরীর চাকরি করে দিনে বড়জোড় ২-৩ ডলার আয় করতেন। পরে তাকে একটি জাহাজের ‘পাইলট’ পদে চাকরির জন্য ৫০০ ডলার বেতনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

এরপর যখন ইউসুফ বুঝতে পারেন যে তাকে একটি জার্মান বাণিজ্যিক জাহাজ ছিনিয়ে নেওয়ার কাজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার আর ফেরার সুযোগ ছিল না।

দ্যা জিওপলিটিক্স ওই প্রতিবেদন বলছে, জলদস্যুতার প্রবণতা বাড়ায় অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণগুলো হল- সোমালিয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মাত্রার দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বারবার ঘটতে থাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

সোমালিয়ায় বছরে মাথাপিছু গড় আয় ৬০০ ডলারের মত। অথচ জলদস্যুরা শুধু একটি জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনায় হাজার হাজার ডলার পেতে পারে।

ওই প্রতিবেদন অনুসারে, জলদস্যু দলের প্রধানরা শিশুদের প্রস্তাব দেয়। বিশেষ করে ১১-১৭ বছর বয়সী শিশুদের এ কাজে প্রলুব্ধ করে। স্বাক্ষরতার হার কম হওয়ায় ‘সহজে’ অর্থ উপার্জনের পথ হিসেবে শিশুরা এ কাজে আগ্রহীও হয়।

দ্যা মেরিটাইম এক্সিকিউটিভ এর ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, শিশুদের জলদস্যুতার কাজে ব্যবহারের আরও কিছু কারণ তুলে ধরা হয়।

যেমন-শিশু ও কিশোররা চটপটে হওয়ায় দ্রুত চলাচল করে, মই বেয়ে উঠতে পারে এবং তুলনামূলক ছোট জায়গার মধ্যে দিয়েও চলে যেতে পারে; যা প্রাপ্তবয়স্করা পারে না।

এছাড়া শিশু-কিশোররা সাহসী এবং পরিণতির চিন্তা না করেই যে কোনো ঝুঁকি নিয়ে নেয়। এমনকি শিশু-কিশোরদের খুব বেশি প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন হয় না।

ছোট নৌযান চালানো, গুলি ছুড়তে পারা এবং বন্দুক পরিষ্কার করতে পারা-এই কয়টি কাজ জানলেই শিশুদের জলদস্যুতার কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জলদস্যু দলের নেতারা শিশু-কিশোরদের দলে নিয়ে দলের সদস্য সংখ্যা দ্রুত বাড়াতে পারে। এতে সহজে তারা জিম্মি করা জাহাজে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে এবং আরও জাহাজে আক্রমণের সক্ষমতা লাভ করে।

আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল-শিশু-কিশোররা নাবিকদের জন্য নৈতিক সমস্যা তৈরি করে। কারণ বেশির ভাগ পেশাদার নাবিক এবং নৌ কমান্ডোরা যখন বন্দুকধারী কোনো শিশুর মুখোমুখি হয় তখন গুলি করতে দ্বিধাবোধ করে; বলা হয় দ্যা মেরিটাইম এক্সিকিউটিভ এর প্রতিবেদনে।

জাহান মণির নাবিকদের পাহারায় ছিল শিশুরা : ২০১০ সালে বাংলাদেশের পতাকাবাহী এমভি জাহান মনি ছিনিয়ে নেয় সোমালি জলদস্যুরা। কবির গ্রুপের মালিকানাধীন ওই জাহাজে ২৬ জন নাবিকসহ ১০০ দিন পর মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত হয়।  

জাহান মণির নাবিক মো. ইদ্রিস ১৪ বছর আগের সেই ঘটনা জানিয়ে বলেন, মাঝ সাগরে জলদস্যুদের যে দল আমাদের জাহাজ জিম্মি করেছিল সেই দলে শিশু-কিশোররা ছিল না। জাহাজ ছিনিয়ে নেওয়ার পর তা সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়।

সেখানে যে দলটি আমাদের পাহারা দিত তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল ১৬-১৮ বছর বয়সী। জলদস্যুদের ‍পুরো দলই মূলত তরুণ-যুবকদের নিয়ে গড়া। সেখানে বয়স্ক লোক খুব কমই থাকে।

ওই নাবিক বলেন, ১৬-১৮ বছর বয়সীরা ছিল সশস্ত্র। তারা সবসময় হাতে অস্ত্র নিয়ে ওয়াচম্যান হিসেবে কাজ করতে। জাহাজের ব্রিজে থাকত। পুরো জাহাজে তারা চলাফেরা করত। তবে তারা আমাদের সাথে কথা বলত না। কথা বলত প্রাপ্ত বয়স্করা।

এবারও একই কোম্পানির মালিকানাধীন আরেকটি পণ্যবাহী জাহাজ সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে। মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাত যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ নাবিকের সবাইকে জিম্মি করে। নাবিকরা সবাই বাংলাদেশী।

তবে এবারের জলদস্যুদের মধ্যে শিশু-কিশোর বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের থাকার তথ্য এখনও সামনে আসেনি। বাংলাদেশি পতাকাবাহী এই জাহাজ আটকের সময় ব্যবহার করা সোমালিয়ার জলদস্যুদের দখলে থাকা এমভি রুয়েনের জলদস্যুদের মধ্যে শিশু-কিশোর ছিলেন।

গ্রেপ্তার কিশোরদের কী হবে : পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে সমুদ্র পথে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ইইউএনএভিএফওআর- আটলান্টা অপরাশেনের ধারণা এমভি আবদুল্লাহ ছিনিয়ে নেওয়ার কাজে মাল্টার পতাকাবাহী এমভি রুয়েন জাহাজটি ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসব খবর আসার পর গত ১৫ মার্চ আরব সাগরে অভিযান শুরু করে ভারতীয় নৌবাহিনী। ১৬ মার্চ ৪০ ঘণ্টার সেই অভিযান শেষে জাহাজটি উদ্ধার করা হয়। অভিযানে আটক ৩৫ জলদস্যুকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের মুম্বাইয়ে। তারা সবাই সোমালীয় নাগরিক।

ভারতীয় নৌবাহিনী মুম্বাই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার জলদস্যু ও উদ্ধার করা সরঞ্জাম হস্তান্তর করে। পরে মুম্বাইয়ের পুলিশ রোববার তাদের মধ্যে ৩৪ জনকে আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে। বাকি একজন জলদস্যু চিকিৎসার জন্য স্থানীয় জে জে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। এদের মধ্যে আটজন জানায় তারা ১৮ বছরের নিচে।  

আদালত ‘অপরাধমূলক কার্যকলাপে’ অভিযুক্তদের ভূমিকা জানতে তাদের মধ্যে ২৬ জনকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছে।

শুনানির সময় সোমালীয় দূতাবাস নিয়োজিত একজন সোমালি নাগরিক অনুবাদক হিসেবে আদালতে উপস্থিত ছিলেন। ওই সোমালীয় বর্তমানে ভারতের পুনেতে শিক্ষার্থী হিসেবে বসবাস করছেন।    

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়-আদালতে হাজির করার পর বিচারক তাদের বয়স জানতে চাইলে, আটজন নিজেদের বয়স ১৮ বছরের কম বলে জানায়। এরপর আদালত তাদের পৃথক জুভিনাইল জাস্টিস বোর্ডে হাজির করানোর নির্দেশ দেয়।

ভারতীয় আইনে, কেউ নিজেকে নাবালক দাবি করলে নথিপত্র যাচাই করে অথবা স্বাস্থ্য পরীক্ষার (অসিফিকেশন টেস্ট) মাধ্যমে তার বয়স নির্ধারণের বিধান রয়েছে। এ কারণে বয়স নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ওই আটজনকে অপ্রাপ্তবয়স্কদের একটি ‘অবজারবেশন হোম’ এ রাখার নির্দেশ দেয় আদালত।   

আদালতের বিশেষ পিপি ইকবাল সোলকার জলদস্যুদের পুলিশ হেফাজতে চাওয়ার আবেদনে বলেন, অস্ত্রের মুখে এমভি রুয়েন জাহাজটি ছিনিয়ে নিয়ে জাহাজ ও এর ক্রুদের মুক্তিপণ বাবদ ৬০ মিলিয়ন ডলার (৫০০ কোটি রুপি) দাবি করা হয়েছিল।  

জলদস্যুদের হেফাজতে চেয়ে পুলিশ আদালতে বলে, ওই ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল তা যাচাই করা প্রয়োজন। কারা জাহাজ মালিকের সঙ্গে মুক্তিপণ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং কারা অভিযানের সময় জাহাজে থাকা ক্রুদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল তাও শনাক্ত করা দরকার।

সোমালীয় দূতাবাস নিয়োজিত গ্রেপ্তারদের পক্ষের আইনজীবী বিশ্বজিৎ সিং আদালতে বলেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শ্রমিক ও নির্দোষ।

এমটিআই

Link copied!