পোস্তায় চামড়া আসছে কম, দামও কম

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২২, ১০:২২ এএম
পোস্তায় চামড়া আসছে কম, দামও কম

ঢাকা : ঈদের দিন থেকে পরবর্তী দুইদিন রাজধানীর পুরান ঢাকার পোস্তায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে। তবে কিছু বড় চামড়ায় ভালো দাম পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। আর এসময় এই এলাকায় চামড়া আমদানিও হয়েছে আগের বছরের তুলনায় কম।

রাজধানীর পুরান ঢাকার পোস্তায় গিয়ে দেখা যায়, চামড়া সংগ্রহের জন্য বসে আছেন গুদাম মালিকরা। কেউ চামড়া নিয়ে আসা মাত্রই কর্মচারীরা তাকে থামিয়ে দরদাম করছেন। গুদাম মালিক তা তদারকি করছেন।

একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, এবার পোস্তায় চামড়া তুলনামূলক কম আর দামও কম। পোস্তায় ঘুরে চামড়ার দরদাম লক্ষ্য করে দেখা যায়, ছোট চামড়ার দাম তুলনামূলক কম বলছেন ব্যবসায়ীরা। কোনো চামড়া দুইশ বা তার কমও বলছেন তারা।

ছোট চামড়ার চাহিদা কম জানিয়ে হাজি কামাল বলেন, কোনো চামড়া নেওয়ার মতো হলে আমরা ৩০০ টাকার কম দাম দিচ্ছি না। আমাদেরও একটা চামড়ায় ৩০০ টাকা মতো খরচ আছে। পাতলা ও ছোট চামড়ায় যে খরচ, বড়-মোটা ভালো চামড়ায়ও তেমনই খরচ। একটা বড় আকৃতির ভালো চামড়া এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়ও কিনেছি। চামড়া ভালো হলে সরকার নির্ধারিত দামের বেশি দিয়েও কিনেছি।

গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা নির্ধারণ করে। ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ১৮ থেকে ২০ টাকা, বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে ও ঢাকায় বকরি ও খাসির চামড়ার দাম একই রাখা হয়। গতবারের তুলনায় চলতি বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭ টাকা এবং খাসির চামড়ায় ৩ টাকা বাড়তি দাম নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়।

ঈদের দিন দুপুরের পর পোস্তায় ছোট আকারের গরুর চামড়া ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি আকারের গরুর চামড়া মানভেদে ৩০০-৭৫০ টাকা এবং বড় আকারের গরুর চামড়া ৮০০-১১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অধিকাংশ আড়তদার ছোট আকারের গরুর চামড়া এবং খাসি ও বকরির চামড়া কিনতে অনীহা দেখান। ছোট আকারের গরুর চামড়া কেউ বিক্রি করতে আনলে ১০০ টাকা দামও বলেছেন ব্যবসায়ীরা। খাসি ও বকরির চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০ টাকায়।

দেশে প্রায় সব পণ্যের দামই এখন বাড়তি। কিন্তু চামড়ার দর কম। কেন এমন হচ্ছে, জানতে চাইলে চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরা কয়েকটি ‘মুখস্থ’ কথা বলেন। পোস্তার আড়তদারদের কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কম। ট্যানারি মালিকেরা তাই বেশি দাম দিতে চান না। তা ছাড়া ট্যানারি মালিকদের কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা বকেয়া থাকায় তারা (আড়তদারেরা) পুঁজিসংকটে রয়েছেন।

অন্যদিকে ট্যানারি মালিক ও চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসায়ীদের যুক্তি হচ্ছে, হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরীর দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি চামড়া কিনছে না। ফলে বাংলাদেশি চামড়ার মূল ক্রেতা এখন চীন। তারা দাম দেয় কম। অন্যদিকে হাজারীবাগে ট্যানারিগুলোর নিজস্ব কারখানার জায়গা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রেড জোন ঘোষণা করে রাখায় সেসব জায়গা বিক্রি করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকঋণ শোধ করতে পারছে না ট্যানারিগুলো। সে কারণে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে।

ব্যবসায়ীদের এত সব যুক্তিতর্কের আড়ালে বিদায়ী ২০২১-২২২ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ৩২ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়েছে। রপ্তানি হয়েছে ১২৪ কোটি মার্কিন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১১ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা।

অবশ্য ব্যবসায়ীরা যেসব যুক্তি দেখাচ্ছেন, সেগুলোর সবই যুক্তিহীনও নয়। ২০০ একর জমিতে একটি চামড়া শিল্পনগরী করতে ১৯ বছর পার করেছে সরকার। প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০৩ সালে। এখনো কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। কঠিন বর্জ্য ফেলার জায়গা বা ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শুরুই হয়নি।

সাভারের চামড়া শিল্পনগর ঘিরে এবারো দূষণের আশঙ্কা করছেন সেখানকার ট্যানারিশিল্পের মালিকেরা। তারা বলছেন, কোরবানির সময়ে ট্যানারিগুলোতে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তা প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা নেই সিইটিপির। কোরবানির চামড়ার কঠিন বর্জ্য অপসারণের জন্য যে পুকুর খনন করা হয়েছে, সেটিও পর্যাপ্ত কি না, তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের দাবি, চামড়া শিল্পনগরের সিইটিপি এখনো পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। সর্বশেষ গত ৬ জুন বর্জ্যের নমুনা পরীক্ষা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাতে দেখা গেছে, টোটাল ডিজলভড সলিড (টিডিএস) ও টোটাল ক্রোমিয়াম এ দুই মানদণ্ডে সিইটিপি এখনো কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছাতে পারেনি।

যদিও শিল্পনগরটির দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) বলছে, দূষণ রোধে এবার তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। চলতি মৌসুমে তরল বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ কমাতে ট্যানারিগুলোতে ওয়াটার মিটার ও ফ্লো মিটার স্থাপন করা হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, ট্যানারির উৎপাদনক্ষমতা অনুসারে তরল বর্জ্য বণ্টনসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে কোনো কারখানা তার চাহিদার চেয়ে বেশি পানি ব্যবহার করলে কিংবা নির্ধারিত পরিমাপের চেয়ে বেশি তরল বর্জ্য নির্গমন করলে তা চিহ্নিত করা যাবে।

চামড়া খাতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্বজুড়ে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। কম দামের কারণে কৃত্রিম চামড়ার পণ্যের জয়জয়কার চলছে। বর্তমানে চামড়াজাত পণ্যের বড় ব্যবসা করছে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের লাক্সারি (বিলাসী) কিছু ব্র্যান্ড। পরিবেশসম্মত উপায়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত না হলে তারা চামড়া কিনছে না। সে জন্য পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী করে আন্তর্জাতিক সংগঠন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ নিতে হবে।

মহিউদ্দিন আহমেদে বললেন, আমরা বর্তমানে প্রতি বর্গফুট চামড়া চীনে ১ ডলারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। ট্যানারিশিল্প পরিবেশবান্ধব হলে সেই চামড়া ৫০৬০ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি করা সম্ভব। একই সঙ্গে ট্যানারি মালিকদের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে ব্যাংকঋণ দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিতে হবে। তাহলেই দুতিন বছরের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ২০০৩০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেটি হলে কোরবানির চামড়ার দামও স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে।

অভিজ্ঞতা না থাকা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সাভারে আধুনিক চামড়া শিল্পনগরী গড়তে লেজেগবরে অবস্থা হয়েছে বিসিকের। সেটি প্রস্তুত না করে হাজারীবাগ থেকে ২০১৭ সালে হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তর করায় বেকায়দায় পড়েন ট্যানারিমালিকেরা। এরপর ব্যবসা একটু খারাপ হতেই চামড়া দাম যায় পড়ে। গত তিন বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানা রকম তৎপরতা নিয়েও সেটিকে আগের জায়গায় নিয়ে যেতে পারেনি। আসলে গোড়ায় হাত দিতে হবে। চামড়া শিল্পনগরের দূষণ বন্ধ করতে হবে। ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে পারলেই কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বাড়বে। পরিবেশও বাঁচবে।

আরেক চামড়া ব্যবসায়ী মেসার্স মাসুম ট্রেডার্সের মালিক জয়নাল দুইদিনে পাঁচ হাজার চামড়া মজুত করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের চামড়া বিক্রি করতে অনেক কষ্ট হয়। ট্যানারি মালিকরা অনেক হিসাব করে চামড়া কেনেন। এর পরেও আমরা ভালো চামড়া পেলে বেশি দাম দিয়ে কিনে রাখছি। এবার চামড়ার বাজার আগের বছরের তুলনায় ভালো যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বলেন, একটা সময় একটা চামড়ার দাম ছিল তিন হাজার টাকা। সেই চামড়া গত কয়েক বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়ও নেমেছিল। তবে এবার চামড়ার বাজার বিগত বছরের তুলনায় ভালো। এবার চামড়া নষ্টও হবে না বলে আশা করছি। ব্যবসায়ীরা চামড়া ফেলে দিচ্ছেন- একসময় এমন পরিস্থিতিও ছিল, এবার তা হবে না। চামড়ার বাজার নিয়ে আমরা আশাবাদী।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনছি। সে দামেই যেন ট্যানারি মালিকরা কেনেন। তাহলে পাইকাররা (কিছুটা লাভে) বিক্রি করতে পারবেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!