৪০৮ বিশিষ্টজনের বিবৃতি

ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের আত্মসমর্পণ

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ৮, ২০১৭, ০৩:১৭ পিএম
ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের আত্মসমর্পণ

ঢাকা: উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে সরকারের আত্মসমর্পণের প্রতিবাদে দেশের ৪০৮ বিশিষ্টজন যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দেশের বেশ কিছু ঘটনা তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সোমবার (৮ মে) বেলা পৌনে ১১টায় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিশিষ্ট সাংবাদিক কামাল লোহানী স্বাক্ষরিত এক ই-মেইল বার্তায় এ বিবৃতি প্রকাশিত হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দেশের বেশ কিছু ঘটনা আমাদের উৎকণ্ঠিত করেছে। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিজাত পরিবর্তন, নববর্ষ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে আক্রমণ, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান সংকুচিত করা, ভাস্কর্য অপসারণের দাবি, কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমান দেয়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাথে সরকারের আপস ও আত্মসমর্পণের ঘটনায় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক মানুষ ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ।

এ বছর প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে যে পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে তা স্বাভাবিক নিয়ম মেনে হয়নি। পাঠ্যপুস্তকের ১৩ জন সম্পাদক গণমাধ্যমে দেয়া বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে, এই পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে তাদের অজান্তে। পাঠ্যপুস্তকের এই সাম্প্রদায়িকীকরণের ঘটনা বছরের প্রথম দিনেই বিনামূল্যে সকল শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে।

ছাপার ভুল, বানান-তথ্য-ইতিহাসের বিকৃতির ঘটনাগুলোকে প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে অবহেলা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হলেও, ধীরে ধীরে বের হয়ে এসেছে এইসব বিকৃতির পেছনের অভিসন্ধি। পশ্চাৎপদ ও মৌলবাদের তোষণনীতির কারণেই পাঠ্যপুস্তকে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তনগুলো আনা হয়েছে। এর পেছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে ভয়ানক বিস্তার রয়েছে, তা গত কয়েক বছর ধরেই স্পষ্ট। এ বছরের পাঠ্যপুস্তকের এই পরিবর্তন সেই সাম্প্রদায়িক অপ-রাজনীতির সঙ্গে সরকারের আপসরফারই চক্রান্ত বহিঃপ্রকাশ।

হেফাজতে ইসলাম শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ছবি আঁকার পাঠ তুলে দিতে চায়। তারা দাবি তুলেছে, পঞ্চম শ্রেণির পর ছেলে-মেয়েদের একসাথে ক্লাশ করা নিষিদ্ধ করতে হবে। হেফাজতের দাবি মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ব্যাপক পরিবর্তনের পর এরই মধ্যে নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার রচনা সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এভাবে একের পর এক সমাজে শিক্ষা, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয়করণ করে জঙ্গিবাদের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে।

তাই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে এই ঘৃণ্য বিকৃতির বিরুদ্ধে আমাদের যেমন কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা আবশ্যক, তেমনি সরকারেরও উচিৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা মুখোশধারী মৌলবাদী ও স্বাধীনতা-বিরোধী ভাবাদর্শের ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদান করা।

উগ্র সাম্প্রদায়িক এই চিহ্নিত গোষ্ঠী ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির প্রতিটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। কেবল বিরোধিতা নয়, তারা বিদেশী কায়েমী স্বার্থ, সাম্রাজ্যবাদ আর হানাদার বাহিনীর দোসর রূপে এদেশের মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল।

সেই চিহ্নিত গোষ্ঠী পঁচাত্তর পরবর্তী  সরকারগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আনুকূল্য পেয়ে আজ দানবে পরিণত হয়েছে। জামায়াত-হেফাজত ইত্যাদি পৃথক পরিচয়েও তাদের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন। আর সেটা হচ্ছে পাকিস্তানী ধারায় বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নেয়া। আজ একথা স্বীকার করতে হবে যে, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে এই অপশক্তি অনেকটাই সফল হয়েছে।

সরকার নিজেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতাবিরোধী বলে প্রচার-প্রচারণা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বললেও, পাঠ্যপুস্তকে কেন এই পশ্চাদপসরণের চিত্র? এই পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে যে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তাতে দেশের অসাম্প্রদায়িক বিবেকবান মানুষ ক্ষুব্ধ। আমরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।

সম্প্রতি কওমি মাদ্রাসার ‘দাওরায়ে হাদিস’কে স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্সের সমমানের সরকারি স্বীকৃতি এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশ মুখে নির্মিত ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য অপসারণের দাবি দেশের অসাম্প্রদায়িক মানুষকে গভীর ভাবে উৎকণ্ঠিত ও বিচলিত করেছে। প্রশ্ন হল, যে কওমি মাদ্রাসার ক্যারিকুলাম ও পাঠ্যসূচিতে সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই; তাকে কোন বিবেচনায় মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেয়া হল? এই হেফাজতপ্রীতি কোন বাংলাদেশের ইঙ্গিত দিচ্ছে?

যে ব্যক্তি ঘোষণা দিয়েছেন মেয়েদের ততটুকুই পড়ালেখা জানা দরকার যতটা শিখলে স্বামীদের পকেটের টাকার হিসাব রাখতে পারা যাবে; নারীদের ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখার কথা বলে তাদেরকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা পর্যন্ত করেছেন বিকৃত রুচির ব্যক্তিটি, দেশের সকল ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন; পহেলা বৈশাখ আর মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন, ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় ভয়াবহ নৈরাজ্য আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে যারা সরকার পতনের ডাক দিয়েছিল, হেফাজতে ইসলামের প্রধান কথিত আল্লামা আহম্মদ শফিই হবেন সেই কমিটির প্রধান, তার কর্তৃত্বেই সনদ দেয়া হবে। তার শিষ্যরা, যারা চিন্তায়-মননে পাকিস্তানি ভাবাদর্শে গড়ে উঠছে, তারা ভবিষ্যতে দেশের প্রশাসনিক পদগুলো দখলে নেবে- এমন ভাবনায় আমরা শিউরে উঠছি।

বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের সামনে নির্মিত ভাস্কর্যটি মানসম্পন্ন হয়নি। একথা স্বীকার করেও প্রশ্ন করা যায়, ঢাকাসহ সারাদেশে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর সবগুলো কি মানসম্পন্ন হয়েছে? যদি মানসম্পন্ন না হয়ে থাকে, শিল্পমানের ঘাটতি থেকে থাকে, তাহলে দেশের প্রতিভাবান শিল্পীদের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে এর মানোন্নয়নের জন্য। কিন্তু হেফাজতের দাবির সাথে সুর মিলানো কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ভাস্কর্য হলো সমাজের ভাবনা ও মননশীলতার প্রতীক। হেফাজতে ইসলাম দেশের সকল অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও মুক্তিসংগ্রামের সকল স্মারক ও সৌধসমূহকেই মূর্তি আখ্যা দিয়ে ভেঙে ফেলার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য শহীদমিনার, স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা, শিখা চিরন্তন ইত্যাদি।

ক্ষমতায় থাকার জন্য অথবা যাওয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা এবং মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সাথে রাখার যে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা দেশকে এক ভয়াল অন্ধকারে নিয়ে যাবে। আমরা সরকারের এই আত্মঘাতি খেলা থেকে বের হয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি এবং এই অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সকল দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/আকন

Link copied!