ফাইল ছবি
আজ ফিলিস্তিনে শিশুর কাঁদা থেমে যাচ্ছে না; তাদের গলা চিরে যাচ্ছে ক্ষুধা, বোমা, ধ্বংস আর অবরোধ। এই কান্না শুধুই একটি জাতির নয়-এটা আমাদের নীরবতার প্রতিধ্বনি। ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে শত শত শিশুর স্বপ্ন, মা-বাবার কোলে লেপ্টে থাকা অবুঝ মুখ, স্কুলব্যাগে ভরা অসমাপ্ত লেখাপড়া। প্রতিটি বোমার শব্দ মানে শুধু একটি ভবন ধ্বংস নয়, বরং একটি শিশুর শৈশব ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাতের খবর শুনে-শুনে বড় হয়েছি এবং ক্রমান্বয়ে বয়স্ক হচ্ছি। সংঘাত চলে, কিছু সময় থামে, আবার শুরু হয়। ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করছে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষকে। নারী-শিশু কেউ বাদ পড়ছে না ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে। এসব দেখেও যেন বিশ্ব বিবেক বোবা হয়ে আছে। ইসরায়েল ক্রমশ ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড দখল করে চলেছে এবং কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ফিলিস্তিনের লোকজনকে একটি তাঁবুর মতো জীবনযাপনের পরিবেশে আবদ্ধ করে রাখছে।
সম্প্রতি বিবিসির একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি দেখা গেছে, গাজার এক পরিবারের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। ওই পরিবারের এক কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছিল — বয়স তিন বছর হওয়ার কথা ছিল। দীর্ঘ ১২ বছর পর একমাত্র কন্যাসন্তানের জন্মে যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবারের মাঝে অনেক আনন্দ বয়ে গিয়েছিল। বাবা পেশায় স্থানীয় ফটোগ্রাফার ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে পরিবারকে নিরাপদ স্থানে রেখে তিনি যুদ্ধকালীন ছবি তোলার কাজ করছিলেন। যুদ্ধের পঞ্চম দিনে খবর পেলেন যে একমাত্র কন্যাসন্তান ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “ইসরায়েল শুধু হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি, ফিলিস্তিন জনগণের সঙ্গেও যুদ্ধ করছে। তারা হত্যা করছে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের।”
দখলদার ইসরায়েলের নীতির কারণে ফিলিস্তিনে লক্ষ লক্ষ নারী ও শিশু অনাহারে, পিপাসায়, চিকিৎসা ও ওষুধের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন। তাদের জীবন আজ শোষণ ও নিষ্ঠুরতার শিকার। অন্য যে কোনো মানুষের মতো তাদেরও অধিকার ছিল শান্তিতে বেঁচে থাকার, কিন্তু তাদের ভাগ্য হয়েছে নিপীড়ন, হত্যা ও ধ্বংস। বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থানের মধ্যে এক — মসজিদ আল-আকসা, যেখানে অনেক নবী রসুল নামাজ আদায় করেছেন — সেখানে আজ আগ্রাসন চলছে। মানবাধিকার ও মানবতা পদদলিত হচ্ছে। তাদের কষ্টের মাত্রা এতটাই গভীর যে কথায় তুলে ধরা কঠিন। নারী ও শিশুদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, চিকিৎসার অভাব, খাদ্য সংকট, এমনকি পানির জন্য তাদের সংগ্রাম — এ সব চিত্র মানবিকতার চোখে কদাচিতই দেখা যায়। যদি গোটা পৃথিবী ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়, তবু ফিলিস্তিনের মানবাধিকার রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হচ্ছে — আরব বিশ্ব ও অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও অনেক ক্ষেত্রে নীরব।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিশ্লেষণে প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে আরও অনেক বেশি। হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত স্থাপনাগুলো ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এই হামলাগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে; তবু বিশ্বশক্তিগুলোর নীরবতা ও দ্বিমুখী নীতির কারণে ইসরায়েল নির্ভয়ে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা অনেক দেশ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন প্রদান করেছে, যা আন্তর্জাতিক ন্যায়ের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন তোলে।
গাজা আজ ধ্বংসস্তূপ আর মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। সেখানে থাকা নারী-শিশুরা মৃত্যু ভয়ে নিদ্রাহীন হয়ে আছে; মাথার উপর দিয়ে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ছুটে চলেছে। ছোট্ট শিশুরা ভয়ে নিজেদের মাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে। যেখানে অবশিষ্ট অল্পটুকু নিরাপদ স্থান আছে, সেখানে মায়েরা তাদের সন্তানদের বাঁচাতে সংগ্রাম করছে। মায়েরা বুকের শিশুকে আঁতকে ধরে রাখে যেন ‘মানব রূপে’ যারা আঘাত করে তারা তাদের বুকের ধন কেড়ে নিতে না পারে।
ইসরায়েলের বর্বর গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকা জটিল। অনেক মূলধারার গণমাধ্যম একপেশাভাবে ইসরায়েলের কদন্তটাই প্রচার করছে; হামাসের নাম সামনে এনে পুরো গাজাবাসীকে দায়ী করা হচ্ছে - যা বাস্তব পরিস্তিতিকে আড়াল করার চেষ্টা মাত্র। কিন্তু বাস্তবতা হলো - ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নিরীহ নাগরিক, স্কুলগামী শিশু, চিকিৎসাধীন রোগী, ঘুমানো পরিবারের সদস্যরা। ইসরায়েল নিরাপত্তার নোঙর দেখিয়ে এই ধরনের হামলা বৈধতার আড়ালে চালাতে চায়। কিন্তু বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন রয়ে যায়-কোনো রাষ্ট্র কি আত্মরক্ষার নামে এক সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালাতে পারে?
ফিলিস্তিনের এই সংকট কেবল ফিলিস্তিনের নয়; এটি পুরো বিশ্ব মানবতার সংকট। যদি গাজার কান্না আমাদের না কাঁদায়, যদি আমাদের বিবেক না নড়ায়, তাহলে আগামী দিনে অন্য কোথাও এমন বর্বরতা ঘটতে পারে- এবং তখন আমরা নিজেদের জন্য প্রতিবাদ করার সময়ও পাব না। ইতিহাস সাক্ষী যে নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো না গেলে নিপীড়ন ধীরে ধীরে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। গাজার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুলের দেয়ালে লেখা ছিল, “আমরা বাঁচতে চাই, শুধু মানুষ হয়ে।” এটি কেবল একটি শিশুর আর্তনাদ নয়, একটি দেয়াল লেখাও নয়; এটি গোটা মানবজাতির বিবেকের পরীক্ষা। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের- আমরা সেই আহ্বানে সাড়া দেব নাকি নীরব থেকে বর্বরতার পৃষ্ঠপোষক হব?
আজ যারা ইসরায়েলের সহায়ক হয়ে ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মানবিক বিবেক ও ন্যায়বিচারের পক্ষে প্রত্যেককে সোচ্চার হওয়া জরুরি। বিশ্বকে গলা উঁচু করে বলতে হবে- এখনই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।
হয়তো একসময় ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে চলা অন্যায় যুদ্ধ শেষ হবে। গাজার মানুষরা স্বাধীনতার স্বীকৃতি পাবে। লাখো মাতৃপিতৃহারা শিশুরা যদি বেঁচে থাকে, তারাও একদিন বড় হবে; তারা জানতে পারবে যে তাদের মাতৃভূমি, পবিত্র মসজিদ আল-আকসা কেন্দ্র করে, তাদের মা-বাবার এমন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। যুদ্ধ নামে চালানো এই অনির্ধেয় হত্যাযজ্ঞের জন্য বিশ্ব-বিশেষ করে যারা মুখে মানবতার কথা বলে কিন্তু কাজ করে নীরবতা-তাদের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার প্রকাশ করবে।
ফিলিস্তিনের নারী-শিশুর কান্না আমাদের বিবেক নাড়ুক। আসুন বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক হওয়া শুরু করি। সুউচ্চ কণ্ঠে বলি- এখনই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।
(লেখক : আহ্বায়ক, জাতীয় নারী আন্দোলন ও যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাপ)
এসএইচ
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :