ঢাকা: বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক বছর পূর্ণ করেছে। এই এক বছরের পারফরম্যান্স মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রশংসার চেয়ে সমালোচনার রেশই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যেসব মৌলিক দায়িত্ব নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল— অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিচার ও প্রশাসনিক সংস্কার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা— তার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য থাকলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ঘাটতি, দ্বিধা ও ব্যর্থতা।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকার যে কঠিন পরিস্থিতি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল, তার মোকাবিলায় কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষা, রেমিটেন্স ও রপ্তানি খাতে গতি ফিরিয়ে আনা— এসব বিষয়ে সরকার কৃতিত্ব দাবি করতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, "সরকার সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই।" তবে তার মতে, এই সাফল্য মূলত বাইরের খাতে— যেমন রেমিটেন্স বৃদ্ধি, আমদানি হ্রাসের কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য তৈরি ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উন্নয়ন ব্যয়ে গতি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এখনও ঘাটতি রয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, "সরকার অর্থনৈতিক নীতির বিষয়ে একটি স্পষ্ট মধ্যমেয়াদী কাঠামো উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। কর আদায় এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না থাকায় অর্থনীতিতে কাঠামোগত দুর্বলতা বিদ্যমান।"
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ছিল বিচার ব্যবস্থার সংস্কার এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে ‘জুলাই হত্যা’-এর বিচারের বিষয়টি জাতির নজর কাড়ে। সরকার এইসব ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, "বিচার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, দলীয়করণ, মামলা বাণিজ্য ও জামিন বাণিজ্য ইতোমধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, যা বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস করছে।"
তিনি আরও জানান, সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর অনেকগুলো প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরও সেগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। প্রশাসনিক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাদ দিয়ে শুধু গৌণ বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে, যেমন টয়লেট পরিষ্কার রাখার নির্দেশনা, যা বৃহত্তর সংস্কারের প্রেক্ষিতে তুচ্ছ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছে সরকার মব ভায়োলেন্স ইস্যুতে। দেশজুড়ে নানা ঘটনায় জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ঢাকার ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য ভাঙচুর, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ঘরবাড়িতে হামলা, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজারো শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা— এসব ঘটনায় সরকারের নির্লিপ্ততা এবং কিছু ক্ষেত্রে পরোক্ষ সমর্থন নিয়েই প্রশ্ন উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, "সরকার মুখে মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারের কিছু উদ্যোগ মবকে বৈধতা দেওয়ার মতো ইঙ্গিত বহন করেছে।" তার মতে, সরকার জনগণের ভয়ের সংস্কৃতি ভাঙতে ব্যর্থ হয়েছে এবং শেখ হাসিনার আমলে গড়ে ওঠা কর্তৃত্ববাদী ধারা থেকেও বেরিয়ে আসতে পারেনি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগ অতীত সরকারগুলোর বিরুদ্ধে যেমন ছিল, তেমনি এই সরকারও একই অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। গত এক বছরে দুই শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় নাম আসা, চাকরিচ্যুত করা, প্রতিষ্ঠান দখল বা নেতৃত্বে হস্তক্ষেপ— এসব ঘটনা গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে।
টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গণমাধ্যম পরিচালনা কাঠামোয় হস্তক্ষেপ একটি বিতর্কিত ও শঙ্কাজনক পরিবেশ তৈরি করেছে।"
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেও মত দিয়েছেন জোবাইদা নাসরীন। তিনি বলেন, "মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অর্জন। অথচ এই সরকারের নানা ফোরাম থেকে সেই চেতনাকে আঘাত করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।"
তার মতে, মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা এবং একে ২০২৪ সালের ঘটনাবলীর সঙ্গে তুলনা করার প্রবণতা একটি ঐতিহাসিক হুমকি তৈরি করছে।
সরকার গঠনের সময় আশাবাদ ছিল যে, অন্তর্বর্তী সরকার দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির বাইরে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। তবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, কেবল দল বদলেছে, কিন্তু দলীয়করণ থেকে বের হওয়া যায়নি। বরং প্রশাসনের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত দলীয় দখল বজায় আছে।
সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বার্থের সংঘাত, দুর্নীতির অভিযোগ, এবং ক্ষমতার অপব্যবহার— এসব অভিযোগও নানাভাবে উঠে এসেছে গণমাধ্যম ও পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণে।
একটি অভ্যুত্থানের পরবর্তী সরকার সবসময়ই নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এক বছরের সময় যথেষ্ট — অন্তত মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি, নীতিমালা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শগত অবস্থান বোঝার জন্য।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "এই এক বছরে সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হয়েছে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জায়গায় ঘাটতি থেকেছে। যে উচ্চ মানসিকতা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল, সেটি বাস্তবায়নে তারা সফল হয়নি।"
সার্বিকভাবে বলা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের জনগণ এখনও সেই প্রত্যাশিত পরিবর্তনের আশায় প্রহর গুনছে। যে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় এ সরকার এসেছে, সেই চেতনা বাস্তবায়নে তার কার্যকর ভূমিকা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
ওএফ
আপনার মতামত লিখুন :