আধুনিক ইউরোপে সিরাতচর্চা

  • আল ফাতাহ মামুন | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২০, ০১:৩৯ পিএম
আধুনিক ইউরোপে সিরাতচর্চা

ঢাকা : বর্তমান দুনিয়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য এবং সমৃদ্ধ জীবনের নেতৃত্ব যেসব দেশের হাতে, ইউরোপ তাদের অন্যতম। অথচ এ ইউরোপকে সভ্যতা শিখিয়েছে ইসলাম। ইসলাম যখন দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল, মুসলিম শাসকরা যখন বিলাসবহুল হাম্মামখানায় গোসল করত, যখন মুসলমানদের লাইব্রেরিতে হাতে লেখা বইয়ের সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখনো ইউরোপের মানুষ মলমূত্র ত্যাগ করার পর পানি নেওয়ার ব্যাপারে জানত না। আধুনিক টয়লেটের কথা তো তারা কল্পনাও করতে পারেনি। আর লাইব্রেরি! সে তো মুসলমানদের থেকে এ বি সি ডি শিখে অনেক বছর পর তারা তৈরি করেছে। সময়ের খেলা বোঝা বড় দায়। আধুনিক ইউরোপকে সভ্যতার সবক দিয়েছে মুসলমানরা; সে কথা আজ স্বপ্নের মতোই মনে হয়। হায়! যে মুসলমান ইউরোপকে অক্ষরজ্ঞান শেখালো, সে ইউরোপের শিল্পীরা আজ মুসলমানদের কলিজার টুকরো নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যঙ্গচিত্র আঁকে এবং নির্লজ্জের মতো তা প্রচারও করে বেড়ায়। অথচ আধুনিক ইউরোপের সমৃদ্ধ সিরাতচর্চা সম্পর্কে জানলে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

ষোলো শতকের কথা। মুসলমানদের নবীর নাম যে ‘মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’, এ বিষয়টিও চরম বিকৃত করে উপস্থাপন করেন পশ্চিমা লেখকরা। সতেরো শতকের শুরুর দিকে একদল লেখক নবীজীবন চর্চায় উন্মুক্ত মন নিয়ে এগিয়ে আসেন। তবে ইসলাম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় ওই সময়ও নবী চরিত্রে কালি লেপনের বিষয়টি বন্ধ হয়নি। এ ঘৃণ্যতা রোধ হয়েছে আঠারো শতকের শেষদিকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে অনবরত মিথ্যা-দুর্নামের প্রতিবাদে একদল কবি-সাহিত্যিক মোহাম্মদ বন্দনায় আত্মনিয়োগ করেন।

মূলত তখন থেকেই আধুনিক ইউরোপ-আমেরিকায় সিরাতচর্চার স্বর্ণযুগ শুরু হয়। উচ্চশিক্ষিতরা মাতৃভাষা ইংরেজির পাশাপাশি আরবি ভাষার ওপরও দক্ষতা অর্জন করেন। তারা আরবি গ্রন্থগুলো অনুবাদ করে মানুষের সামনে ইসলাম এবং বিশুদ্ধ নবীজীবন তুলে ধরেন। সে সময় ইউরোপে ইসলাম এবং ইসলামী সাহিত্যের জাগরণ এত বেশি পরিমাণে হয়েছে যে, ১৮৮০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত মাত্র ক’বছরেই ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ষাট হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রচিত হয়। শুধু আমেরিকাতেই অর্ধশতেরও বেশি ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। যার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে।

পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাষায় আরবি গ্রন্থ অনুবাদের পাশাপাশি খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বন্দনায় রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা-প্রবন্ধ-বই এবং গবেষণাকর্ম।

পশ্চিমা বিশ্বের মহাকবি খ্যাত দান্তে, গ্যেটে, পুশকিন নিজ নিজ কবিতায় মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আধুনিক ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট লেখেন- ‘মোহাম্মদ কেবল আজীবন দানই করে গেছেন, কারো দান গ্রহণ করেননি।’ মহাকবি গ্যেটে তার কবিতায় মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘পাহাড়ের ঝরনা’ বলে উল্লেখ করেছেন। রুশ কবি পুশকিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। যার শিরোনাম দিয়েছেন- ‘দ্য প্রফেট’। স্কটল্যান্ডের জনপ্রিয় সাহিত্যিক টমাস কার্লাইল ১৮৪০ সালের ৮ মে এক ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলেন, ‘একটি জাতি, নাম আরব জাতি। একজন মানুষ, নাম মোহাম্মদ। যার শিক্ষা এবং সংস্কার আরবের গন্ডি পেরিয়ে দিল্লি থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত জয় করেছে প্রতিটি দেশ ও জাতিকে।’ বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক আল ফ্রেড দে লা মার্টিন তার তুর্কি ইতিহাসের প্রথম খণ্ডে খুব জোর দিয়েই বলেছেন, ‘দার্শনিক, বক্তা, ধর্মপ্রচারক, বীর যোদ্ধা, আইনপ্রণেতা, প্রতিমামুক্ত প্রার্থনা পদ্ধতির সফল প্রতিষ্ঠা হিসেবে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মতো অনন্য মানুষ পৃথিবীর বুকে আর আসেনি, আসবেও না। একজন মানুষের পক্ষে যতগুলো ভালো গুণ, মহৎ গুণের অধিকারী হওয়া সম্ভব; তার সবগুলো গুণ মোহাম্মদের মাঝে ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একজন মানুষেরও জন্ম হয়নি যার সঙ্গে মোহাম্মদের তুলনা হতে পারে। মোহাম্মদের তুলনা মোহাম্মদ নিজেই।’

ইউরোপীয় সাহিত্য সমালোচক ও প্রখ্যাত লেখক ডেভেন পোর্ট সিরাতের ওপর লেখা তার রচনায় বলেন, ‘পবিত্র বাইবেলে উল্লেখিত প্রতিশ্রুত ‘পারাক্লীত’ বা শান্তিদূত হলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।’ পশ্চিমা লেখকরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহুবিবাহের রেশ টেনে তাকে ‘নারীলোলুপ’ অপবাদ দিলে ডেভেন পোর্ট কঠিন ভাষায় এর প্রতিবাদ করেন। তিনি যুক্তির আলোকে পশ্চিমাদের অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, ‘পঁচিশ বছরের যুবক মোহাম্মদ চল্লিশ বছরের বিবাহিত নারী খাদিজা (রা.)-কে বিয়ে করেছেন। খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে দীর্ঘ পঁচিশ বছর দাম্পত্য জীবনে তিনি আর কোনো নারীকে গ্রহণ করেননি। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে খাদিজা যখন ইন্তেকাল করেন তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিল পঞ্চাশ। পঞ্চাশের পর তিনি অন্যান্য স্ত্রীকে গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে সবাই ছিলেন বয়স্কা অথবা বিবাহিতা। একমাত্র আয়শা (রা.) ছিলেন কুমারী। তাহলে একজন ‘নারীলোলুপ’ ব্যক্তির পক্ষে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত এক নারীতে সন্তুষ্ট থাকার পর বয়স্কা এবং বৃদ্ধা মহিলাদের বিয়ে করা কী করে সম্ভব হয়?’ এরপর ডেভেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহুবিবাহের কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং সমালোচনার দাঁতভাঙা জবাব দেন। পশ্চিমা বিশ্বের জনপ্রিয় একটি এনসাইক্লোপিডিয়ার নাম ‘চেম্বার এনসাইক্লোপিডিয়া’। সেখানে সিরাতের ওপর একটি প্রবন্ধ সংকলন করা হয়। প্রবন্ধের নাম ‘মিরাকল অব মোহাম্মদ’। প্রবন্ধে বলা হয়, ‘মোহাম্মদ (সা.) শিক্ষা, সংস্কৃতি-সভ্যতার যে সুবিশাল অট্টালিকার ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, তার সুফল এখন আধুনিক বাগদাদ, সিরিয়া, স্পেন, ইউরোপসহ পুরো বিশ্ব ভোগ করছে।’

১৯৭৪ সালের ১৫ জুলাই বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘টাইমস’-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘একজন নেতার তিনটি গুণ থাকতে হয়। এক. অনুসারীদের কল্যাণ কামনা করা। দুই. একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা, যাতে করে অনুসারীরা সমাজবদ্ধ নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারে। তিন. অনুসারীদের জন্য সুনির্ধারিত বিশ্বাসমালা তৈরি করা। যে বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা জীবন পরিচালনা করে সফলতার স্বর্ণসিঁড়ি পার হবে।’ দার্শনিক ও নেতাদের মধ্যে পাস্তর, সালক ছিলেন প্রথম গুণের অধিকারী। গান্ধী, কনফুসিয়াস, আলেকজান্ডার, সিজার, হিটলার ছিলেন প্রথম ও দ্বিতীয় গুণের অধিকারী। একমাত্র মোহাম্মদই ছিলেন তিনটি গুণের সফল সমন্বয়কারী আশ্চর্য মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ মহান নেতা এবং মানবতার ত্রাণকর্তা।’

পশ্চিমা বিশ্বে সিরাতচর্চায় মাইকেল এইচ হার্টের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদ। বিশ্বের সেরা একশ ব্যক্তির জীবনী নিয়ে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত বই ‘দ্য হানড্রেড’। এখানে তিনি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রথম স্থান দেন এবং তাদের ধর্মের নবী ঈসা (আ.)-কে রাখেন দ্বিতীয় স্থানে। ভূমিকায় তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রথম এবং ঈসা (আ.)-কে দ্বিতীয় স্থানে দেখে অনেকেই আশ্চর্য হতে পারেন। সত্যি বলতে ইতিহাসে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় ও বৈষয়িক দুটো ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সফলতা লাভ করেছেন।’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ধর্মীয় বিষয়ের প্রধান ভাষ্যকার ক্যারেন আর্মস্ট্রং অতিসমপ্রতি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সিরাতের ওপর এক অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেন। ‘মোহাম্মদ : আ বায়োগ্রাফি অব প্রফেট’। এ গ্রন্থে ক্যারেন আর্মস্ট্রং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো বাস্তবতা এবং যুক্তির কষ্টিপাথরে খণ্ডন করে প্রমাণ করেন- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন অনুপম চরিত্রের অধিকারী অনন্য মানুষ।

ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং ভাষাগত দিক থেকে উৎকর্ষ মানের সিরাত গ্রন্থের মধ্যে মার্টিন লিংসের ‘মোহাম্মদ : হিজ লাইফ বেসড অন আর্লিয়েস্ট সোর্স’ প্রথম সারির অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮৩ সালে লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বইটি পশ্চিমা বিশ্বে সিরাতচর্চায় নতুন অধ্যায় সূচনা করে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাসহ একাধিক এনসাইক্লোপিডিয়ার নিবন্ধকার লেখক লিংস। ইসলামে দীক্ষিত হয়ে তিনি মার্টিন লিংসের পরিবর্তে ‘আবু বকর সিরাজ’ নাম ধারণ করেন। পাশ্চাত্যের আরো অনেক লেখকই সিরাতচর্চায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- হাঙ্গেরির ড. জুলিয়াস জার্মান, স্যার টমাস আর্নল্ড, এডুইন আর্নল্ড; ফ্রান্সের লা মার্টিন, ড. এ বার্থারেন্ড, ডব্লিউ হুকিং, এডওয়ার্ড হেমিল্টন; ওলন্দাজের কবি ভ্যান মিল্টন, গাট সিমিপি; মার্কিন লেখক ও গবেষক জর্জ সারটেন, ড. মরিস এবং ড. স্টংগাচ প্রমুখ।

লেখক : সাংবাদিক

 

Link copied!