অপসংস্কৃতি রোধে ইসলামী সংস্কৃতি

  • মুফতি মো. এহসানুল হক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২১, ০২:০১ পিএম
অপসংস্কৃতি রোধে ইসলামী সংস্কৃতি

ঢাকা : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামী জীবনাদর্শ ও শরিয়ার বিধান অনুশীলনের ফলে মানুষের ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডে যে প্রভাব পরিলক্ষিত এবং কল্যাণকর বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটে তাই হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনসত্তার অন্তরঙ্গ ও বহিরাঙ্গের সামগ্রিক রূপ। সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার, বিশ্বাসলব্ধ মূল্যবোধে উদ্ভাসিত, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত মন-মানসিকতাকেই সংস্কৃতি বলা হয়। ইসলামের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে মানুষ তার আচার-ব্যবহার, দেহ, মন ও আত্মাকে যেভাবে সংস্কার ও সংশোধন করে, তাই ইসলামী সংস্কৃতি। ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি হলো  কোরআন ও সুন্নাহ। সুতরাং  কোরআন-সুন্নাহর ভাবধারার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো সংস্কৃতিই ইসলামী সংস্কৃতি হতে পারে না। সমাজবিজ্ঞানীদের ভাষায় সংস্কৃতি হলো জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নিয়ম-নীতি, সংস্কার ও অন্যান্য দক্ষতা যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জন করে। অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো মানুষের আচরণের সমষ্টি।

ইসলামী সংস্কৃতি যেমনভাবে মানুষকে সুসংহত করতে পারে, তেমনি অপসংস্কৃতি মানুষকে সমূলে ধ্বংস করে দিতে পারে। সংস্কৃতি যদি মানবতা ও নৈতিকতাবিবর্জিত হয় এবং ধর্মীয় নীতির অনুকূলে না হয়। আমরা মুসলমান জাতি হওয়ার কারণে আমাদের শিষ্টাচার, সংস্কৃতিও হতে হবে ইসলামী।  কোরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত কোনো সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি বলা যাবে না। কোরআন-সুন্নাহর সীমানা ও চিরায়ত রীতির পরিপন্থি যা কিছু হবে সবই মুসলমানদের জন্য অপসংস্কৃতি।

মুসলিম উম্মতের অভ্যন্তরে বিজাতীয় যে কোনো জাতির আচার-আচরণ, পোশাক ইত্যাদিসহ সব ধরনের সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটা অপসংস্কৃতি। আর এসব অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে মুসলিম উম্মাহ আজ আক্রান্ত। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও আজ অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে মুসলমান তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চায় মত্ত। পশ্চিমা বিশ্বের অপসংস্কৃতির বিষবৃক্ষ আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর পূর্বে ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে রোপণ করেছিল, ফল দিতে শুরু করেছে। আড়াইশ বছর আগের বৃক্ষের ফল খেয়ে আজ মুসলিম উম্মাহ আক্রান্ত। তিক্ত হলেও সত্য যে, ইসলামী সংস্কৃতি আজ মাতৃকোলচ্যুত হয়ে ভূতের কোলে ঠাঁই নিয়েছে।

অপসংস্কৃতির কালো থাবায় জাতি আজ আহত। পশ্চিমা বিশ্বের পরিত্যক্ত কৃষ্টি-কালচার আজ মুসলিম জাতিও পালন করতে শুরু করেছে। আমাদের সমাজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আবহে ধূমায়িতপ্রায়। অপসংস্কৃতির ছোবলে গোটা সমাজ ক্রমশ দূষিত হয়ে উঠেছে। এর ফলে বিলুপ্ত হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতি। মুসলমানদের গোটা জীবনই সংস্কৃতি। আমাদের জীবনের প্রতি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে, আহারে, বিহারে, অজু, গোসলে, আমোদ-প্রমোদে, আপ্যায়নে-অভ্যর্থনায়, হাঁটা-চলায়, আলাপ-আলোচনায় সর্বক্ষেত্রেই মিশে আছে রক্তের মতো দেহের স্পিরিট শিরা-উপশিরায়। দেহের রক্তের সঙ্গে ইসলামী সংস্কৃতির তুলনা করা যায়। রক্তশূন্য দেহ প্রাণহীন একটি লাশ মাত্র। আর সংস্কৃতিবিহীন মানবদেহ পাথরের সমতুল্য।

ইসলামের সংস্কৃতি শুধু দীন বা ইবাদত, বিচ্ছিন্ন নয়। জীবন-বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির অনুষ্ঠান পালনের জন্য মুসলমানদের আলাদা আয়োজনের তেমন প্রয়োজন হয় না। এ জন্য মুসলমানের ইসলামী জিন্দেগি সবটাই সংস্কৃতি। ইসলামী সংস্কৃতি অনুষ্ঠাননির্ভার নয়। ইসলামী সংস্কৃতি আবার বিশেষ স্বকীয় অনুষ্ঠানকে অস্বীকারও করে না। ইসলামী সংস্কৃতির একটি মানদণ্ড আছে তা আল্লাহ প্রদত্ত। এই মানদণ্ড নির্ণয় করে সংস্কৃতি পালন করাই মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। কিন্তু সমাজে এমনও অনেক মুসলমান রয়েছেন যারা ইসলামী সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতির নির্ণয়ে অসচেতন। যার কারণে মুসলিম পরিবারেও প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে অপসংস্কৃতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ইসলামী সংস্কৃতি পরিহার করে সংস্কৃতির নামে চালানো হচ্ছে ভয়াবহ অপসংস্কৃতি। সমাজে আমাদানিকৃত কতিপয় সংস্কৃতির নাম উপস্থাপন করা হলো। জন্মোৎসব সংস্কৃতি, শোক প্রকাশ সংস্কৃতি, এপ্রিল ফুল সংস্কৃতি, ভ্যালেন্টাইনস ডে সংস্কৃতি, পয়লা বৈশাখ সংস্কৃতি, থার্টফাস্ট নাইট ডে সংস্কৃতি, দিবস পালন সংস্কৃতি, বিয়ে অনুষ্ঠান সংস্কৃতি ইত্যাদি।

জন্মোৎসব সংস্কৃতি : আমাদের সমাজে জন্ম তারিখ (বার্থ-ডে) কেন্দ্র করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-পড়শীদের উপস্থিতিতে জন্মোৎসব নামের অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়। ইসলাম কারো জন্ম বা মৃত্যু দিবস উদযাপন সমর্থন করে না। জন্মবার্ষিকী পালন করা বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। জন্মদিবস উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে প্রচুর টাকা অযথা অপচয় করা হচ্ছে। কেক কাটা, মোমবাতি, আগরবাতি জ্বালিয়ে এতে অনর্থ অর্থ ব্যয় করা হয় যা অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত।  আর পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। কেবল জন্মোৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে নয় একজন মুসলমানের উচিত জীবনের সব  ক্ষেত্রে অপচয় থেকে বিরত থাকা। অপচয়ের মতো অপব্যয়কে নিষিদ্ধ করে আল্লাহপাক কোরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন, ‘আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৬,২৭) আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘তোমরা আহার করবে ও পান করবে। কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আল আরাফ, আয়াত-৩১)

পয়লা বৈশাখ সংস্কৃতি : বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে প্রচুর টাকা অযথা অপচয় করা হচ্ছে। পান্তা-ইলিশ ও বৈশাখি ড্রেসসহ গান-বাজনার মাধ্যমে এ দিবসটি উদযাপিত হয়। পহেলা বৈশাখের সকালে পান্তা খাওয়ার প্রথা এবং শাদা শাড়ি প্রভৃতি হলো পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রধান উপাদান। আর এসব কর্মকাণ্ড ইসলামে হারাম। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ধর্মের মানুষের (ধর্মীয় আচারের) অনুকরণ বা সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪০৩১) নববর্ষের অনুষ্ঠানে চরমভাবে লঙ্ঘিত হয় ইসলামের পর্দার বিধান। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, বিচরণ ও নারীকে জড়িয়ে নানা রকম অশ্লীলতা সৃষ্টি হয়, অথচ ইসলামে পর্দা করা ফরজ। আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘হে নবী! আপন বিবি, কন্যা এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের শরীর ও মুখমণ্ডল চাদর দ্বারা আবৃত করে রাখে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত-৫৯) পহেলা বৈশাখকে গান-বাজনার মাধমে বরণ করা হয়। অনুষ্ঠানগুলোতে উন্মুক্তভাবে গান-বাজনার ছড়াছড়ি। অথচ আল্লাহপাক গান-বাজনাকে হারাম করেছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘গান মানব অন্তরে নিফাক সৃষ্টি করে; যেমন পানি রবিশষ্য উৎপাদন করে।’ (রুহুল মাআনি-৭/৬৮) অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘গানবাদ্য শ্রবণ করা কবিরা গুনাহ এবং গানের অনুষ্ঠানে বসা ফাসেকি আর এর দ্বারা আনন্দানুভব করা কুফরি। (আবু দাউদ, হাদিস নং-৬৭৪)

শোক প্রকাশ সংস্কৃতি : আমাদের সমাজে শোক পালন হচ্ছে মনগড়া রীতিতে যা ইসলাম সমর্থন করে না। কারো  শোক প্রকাশে মাথায় কালো পট্টি বাঁধা বা এক মিনিট দাঁড়িয়ে শোক প্রকাশ করা ইসলামে বৈধ নয়। শোক পালনের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হলো কোনো মহিলা তার স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করবেন। এছাড়া অন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিন পর্যন্ত শোক পালন করতে পারবেন।

এপ্রিল ফুল সংস্কৃতি : পহেলা এপ্রিলের সাথে জড়িয়ে আছে মুসলমানদের বেদনাময় এক ইতিহাস। পশ্চিমা বিশ্ব ও খ্রিস্টানদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। তারা সীমাহীন আনন্দের সাথে এ দিবসটি পালন করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিজাতীয় গোষ্ঠীর কালচার মুসলমানদের কেউ কেউ পালন করছেন। এ দিন আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা একে অন্যকে বিভিন্ন কৌশলে ধোঁকা দিয়ে বোকা সাজিয়ে হাসি তামাশায় মেতে ওঠেন। ১ এপ্রিল বা এপ্রিল ফুল-ডে এর সাথে জড়িয়ে আছে মুসলিম মিল্লাতের রক্তঝরা এক কালো অধ্যায়। এর ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৪৯২ সালে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মিথ্যাবাদী প্রতারক কুখ্যাত ফার্ডিন্যান্ড ও রাণী ইসাবেলার  খ্রিস্টান বাহিনী শহরে প্রবেশ করে মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। এরপর রাতের আঁধারে একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদের চারপাশে আগুন লাগিয়ে মসজিদে আশ্রয় গ্রহণকারী নিরস্ত্র নিরপরাধ মুসলিম শিশু-বৃদ্ধ নরনারীকে নৃশংসভাবে পুড়িয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। অসংখ্য নারী-পুরুষ-শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান মসজিদের ভেতর। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধ অসহায় মুসলিমদের আর্তচিৎকার যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও শোকাতুর করে তুললো, তখন ফার্ডিন্যান্ড রাণী ইসাবেলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে হেসে বলতে লাগলো, হায় মুসলিম! (হায় এপ্রিল ফুল) এপ্রিলের বোকা। মুসলিমদের বোকা বানিয়ে মুসলিম ইতিহাসের এক রক্তাক্ত জঘন্য উৎসবে মেতেছিল খ্রিস্টানরা। একদিন যে কর্ডোভা ও গ্রানাডার মসজিদগুলো থেকে পাঁচ ওয়াক্ত আজান ধ্বনিত হতো, আন্দোলিত হতো স্পেনের মুসলমানদের হূদয়, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সব গীর্জার স্তম্ভ। এপ্রিল ফুল দিবস উদযাপন করা ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের পরিপন্থি। হাদিসের মধ্যে রাসুল (সা.) ধোঁকাবাজির পরিণাম সর্ম্পকে এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যকে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম, হাদিস নং-২৪৮) রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘অভিশপ্ত ওই ব্যক্তি যে কোনো মুমিন ব্যক্তির ক্ষতি সাধন করে কিংবা তাকে ধোঁকা দেয়।’ (মিশকাত, হাদিস সং-৪২৮)

ইসলামী সংস্কৃতি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও আপন গুণে গুনান্বিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান মুসলিম সমাজেও পাশ্চাত্য তথা পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও পৌত্তলিকতার ভাবধারায় গড়া সংস্কৃতি বিরাজমান। এসব অপসংস্কৃতি থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য জরুরি ইসলামী সংস্কৃতি। ইসলামী সংস্কৃতির চর্চা এনে দিতে পারে সুস্থ সংস্কৃতি, আর একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে অতীব জরুরি সংস্কৃতির সুস্থতা। অপসংস্কৃতির অবসান হোক, সুস্থ সংস্কৃতির জয় হোক প্রত্যাশা এটাই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও অধ্যক্ষ, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার
মুহতামিম, ইসলামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদরাসা, শ্রীমঙ্গল

 

Link copied!