নকল চেকে ব্যাংক থেকে চলে যাচ্ছে গ্রাহকের টাকা

  • সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০১৬, ০৭:৫৬ পিএম
নকল চেকে ব্যাংক থেকে চলে যাচ্ছে গ্রাহকের টাকা

বিশেষ প্রতিনিধি

দেশের ব্যাংকিং খাতে চেক জালিয়াতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। এমনকি চেক জালিয়াতি ঠেকাতে ম্যাগনেটিক ইঙ্ক ক্যারেকটার রিকগনিশন (এমআইসিআর) চেক চালু করেও রেহাই মিলছে না। বরং সংঘবদ্ধ চক্র নিখুঁতভাবে নকল চেক তৈরি করে ব্যাংক থেকে গ্রাহকের কষ্টের জমানো টাকা তুলে নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ সংক্রান্ত বিপুল অভিযোগ এসেছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের সত্যতা মিলছে। জাল চেক দিয়ে টাকা উত্তোলনের পর কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া অর্থ ভুক্তভোগী গ্রাহকের এ্যাকাউন্টে জমা করা হচ্ছে। তবে কোনো ব্যাংকই বড় জালিয়াতির ঘটনাগুলোর সুরাহা করতে পারছে না। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন চক জালিয়াতি প্রতিরোধে নীতিমালা করা যায় কিনা তা খতিয়ে দেখছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে চেক জালিয়াতির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে (সিআইপিসি) প্রতিমাসেই ২০ থেকে ২৫টি চেক জালিয়াতি সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়ছে। গত অর্থবছরে চেক সংক্রান্ত ১৭৫টি অভিযোগ ছিল। তার আগের বছর ছিল ২০৯টি। ইতিমধ্যে তার অধিকাংশই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চেক জালিয়াতির মধ্যে সর্বাধিকসংখ্যক ঘটনা ঘটেছে বসরকারী খাতের সিটি ব্যাংকে। তারপরে রয়েছে ব্র্যাক ও আইএফআইসি ব্যাংক। তাছাড়া ডাচ্-বাংলা, পূবালী, এবি, ইস্টার্ন, জনতা, সোনালী ব্যাংকেও একাধিক চেক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে বেসরকারি ৩টি ও সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান চেক প্রস্তুত করে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- নেট ওয়ার্ল্ড, জাপান বাংলাদেশ প্রিন্টিং কর্পোরেশন, সেকুরা প্রিন্টিং ও বাংলাদেশ সিকিউরিটি এ্যান্ড প্রিন্টিং কর্পোরেশন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক জালিয়াতির সাথে চেক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি চেক জালিয়াতি সংক্রান্ত বেশকিছু অভিযোগ তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের কর্মকর্তার যোগসাজশে জালিয়াতি হয়েছে বলেও প্রমাণ মিলেছে। এসব ঘটনায় অনেক কর্মকর্তাকেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংক চাকরিচ্যুত করেছে। এ ধরনের ঘটনা ব্যাংক খাতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হওয়ায় এখন কোনো নীতিমালা করা যায় কি না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে প্রাপ্ত অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংকের ভুয়া চেকে ১৮টি ক্লিয়ারিং হাউসের লেনদেনে ৩ কোটি ১৬ লাখ ৬৫ হাজার ২৫০ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকে ক্লিয়ারিংয়ে একটি ভুয়া চেকে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭০ টাকা এবং ব্যাংকের অভ্যন্তরে ১৬টি ঘটনায় ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া বিদেশী খাতের এইচএসবিসি ব্যাংকে ক্লিয়ারিংয়ের ১৪টি লেনদেনে ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা এবং সরাসরি ব্যাংক থেকে ৪টি ঘটনায় ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়েছে। আর পূবালী ব্যাংকের ১৩টি ঘটনায় প্রায় ৩০ লাখ, এবি ব্যাংকে ১১টি ঘটনায় প্রায় ৪৮ লাখ, সোনালী ব্যাংকে ৫টি ঘটনায় ১০ লাখ ৫২ হাজার, জনতা ব্যাংকে ৭টি ঘটনায় ৮৬ লাখ ৫৯ হাজার, অগ্রণী ব্যাংকে ৩টি ঘটনায় ১ লাখ ৩২ হাজার, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৫টি ঘটনায় ১১ লাখ ৪৪ হাজার, ঢাকা ব্যাংকে ৯টি ঘটনায় প্রায় ১ কোটি ৩৬ লাখ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে ১২টি ঘটনায় ১ লাখ ২২ হাজার, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ২টি ঘটনায় ৮৩ লাখ ৩০ হাজার, ওয়ান ব্যাংকে ২টি ঘটনায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৩টি ঘটনায় ৩ লাখ ৫৩ হাজার, নতুন অনুমোদিত মধুমতি ব্যাংকে ২টি ঘটনায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা জাল চেকের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, ব্যাংক ব্যবস্থার নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রাহকের চেক ইস্যুতে ম্যাগনেটিক ইঙ্ক ক্যারেক্টার রিকগনিশন (এমআইসিআর) বাধ্যতামূলক করা হয়। আর ব্যাংক গ্রাহককে নির্দিষ্ট সংখ্যক পাতার চেক বই হস্তান্তর করে। কিন্তু তার মধ্যে একই সিরিয়ালের ভুয়া পাতা তৈরি করা হচ্ছে। ডুপি¬কেট ওই পাতা ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ তুলে নেয়া হচ্ছে। কিছু ব্যাংক অর্থ হস্তান্তরের পূর্বে সংশি¬ষ্ট গ্রাহকের স্বাক্ষর যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যাংকের উদাসীনতা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমনই জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হওয়া অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চেকের এমআইসিআর লাইনটি মেশিন রিডেবল না হওয়া সত্ত্বেও চেক উপস্থাপন করে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। ইউভি মেশিনে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা, মূল চেকের হুবহু নকল করা হয়েছে, এমআইসিআর লাইনটি ঘষামাজা, স্ক্যানার মেশিন রিড করতে না পারা, গ্রাহকের কাছে প্রকৃত চেক থাকা সত্ত্বেও জাল চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে।

এদিকে চেক জালিয়াতি প্রসঙ্গে সরকারি ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এমআইসিআর চেক ব্যবহারে চেক জালিয়াতি হওয়ার কথা নয়। তারপরও একটি চক্র দক্ষতার সাথে জালিয়াতি করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলো অবশ্য সতর্ক রয়েছে। আর ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যদি ওই অপতৎপরতার সাথে যুক্ত থাকে তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ব্যাংকিং খাতে ছাপানো প্রযুক্তির ব্যবহাওে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। তারপরও কেউ ইচ্ছা করলে প্রায় কাছাকাছি একটি চেক ছাপানো কঠিন কাজ নয়। সেক্ষেত্রে ব্যাংককেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাহকের স্বাক্ষর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মিলিয়ে দেখা, বড় অঙ্ক তথা এক লাখ টাকার চেক হলেই গ্রাহককে জিজ্ঞাসা করার বিধান রয়েছে। এভাবেও অনেক জালিয়াতি ধরা পড়েছে।

 

সোনালীনিউজ/এমএইউ

Link copied!