বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়, পরিকল্পনা কমিশনের তীব্র আপত্তি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১৯, ২০১৬, ০৩:৪১ পিএম
বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয়, পরিকল্পনা কমিশনের তীব্র আপত্তি

জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এমনকি কেন এত অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রস্তাব করা হলো তার সুস্পষ্ট জবাবও চেয়েছে কমিশন। মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিড বিদ্যুৎ সরবরাহে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে।

প্রায় ২১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সঞ্চালন লাইন ঢাকার মেঘনাঘাট থেকে চট্টগ্রামের মদুনাঘাট পর্যন্ত যাবে। তাতে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্পের এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের প্রস্তাব তীব্র আপত্তি পরিকল্পনা কমিশন। ইতঃপূর্বে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একই ধরনের আপত্তির পর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়।

সম্প্রতি অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে রামপালে দ্বিতীয় ইউনিট বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও প্রস্তাবও একনেক থেকে এক দফা ফেরত পাঠানো হয়। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মেইন পাওয়ার গ্রিড নির্মাণ' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। তাতে ৪ হাজার ৭৪৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। তার মধ্যে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ঋণ হিসেবে দেবে ২ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। আর সরকারের তহবিল থেকে ঋণ ও ইক্যুইটি হিসেবে দেওয়া হবে ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা।

অবশিষ্ট অর্থ পিজিসিবির নিজস্ব তহবিল থেকে সরবরাহ করার কথা। কিন্তু পিজিসিবি সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের এমন প্রস্তাবে কয়েকটি খাতের ব্যয় নিয়ে আপত্তি তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। তার মধ্যে পরিবহন খাতে ব্যয় ৪২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খরচ সাড়ে ৫ কোটি টাকাকে কমিশন অনেক বেশি মনে করছে।

প্রকল্পে ২৬টি গাড়ি কেনাকেও অস্বাভাবিক মনে করা হচ্ছে। তার মধ্যে কোটি টাকা ব্যয়ে ৩টি বিলাসবহুল জিপ কেনার প্রস্তাব দিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা। ওই খরচের বাইরে গাড়ি পরিচালনা বাবদআরো সাড়ে ৬ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, পরিকল্পনা কমিশন বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের ভাতার প্রস্তাবেও তীব্র আপত্তি তুলেছে। কমিশনের মতে- একজন প্রকল্প পরিচালকের মাসিক ৭৪ হাজার ১০০ টাকা ধরে বছরে ৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা বেতন ধরা হয়েছে। কিন্তু নামে-বেনামে বিভিন্ন খাতে ভাতা ধরা হয়েছে বেতনের দ্বিগুণ। প্রকল্প পরিচালকের ভাতাতেই যাবে ১৬ লাখ ১২ হাজার টাকা।

শুধু পরিচালকই নয়, প্রকল্পের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও হরেক রকমের ভাতার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যে কারণে শুধু ৮৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভাতা বাবদ চাওয়া হয়েছে ২৫ কোটি ৬১ লাখ টাকা। যেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়ে বেতনে ব্যয় হবে ১২ কোটি টাকারও কম। তা ছাড়া কমিশন মনে করছে প্রকল্পের পরামর্শক খাতেও অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

পরামর্শকের জন্য ১৩১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। অথচ ভূ-উপরস্থ এই ধরনের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের অভিজ্ঞতা পিজিসিবির আছে। অতিরিক্ত পরামর্শকের পেছনে বিপুল ব্যয়ের প্রস্তাবে আপত্তি তুলেছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। তার বাইরে মিটিংয়ের সম্মানী রাখা হয়েছে ২০ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এমন প্রতিটি খাতে অযৌক্তিক ব্যয় ধরে প্রকল্প-ব্যয় বাড়ানো হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, সঞ্চালন লাইন প্রকল্পে ব্যয়ের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ২ হাজার ১১৪ কোটি টাকা, ভ্রমণ ব্যয় ৬৯ লাখ, ওভারটাইম ২ কোটি, কর ১১৩ কোটি, ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৪ কোটি, যন্ত্রপাতি ৫২ কোটি, আসবাব ৩৮ লাখ, ভূমি অধিগ্রহণ ১০১ কোটি টাকা এবং ভূমি উন্নয়নে ১১ কোটি টাকা। তা ছাড়া বাসভবন নির্মাণে ৮০ লাখ টাকা। বৈদ্যুতিক স্থাপনা ও ফিজিক্যাল কন্টিজেন্সি বাবদ বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- বিদ্যুৎসহ কয়েকটি খাতের প্রকল্প ব্যয় নিয়ন্ত্রণহীন। অস্বাভাবিক ব্যয় ধরে যোগসাজশে কর্মকর্তারা প্রকল্প অনুমোদন নিচ্ছেন। বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ তার বড় প্রমাণ। অবশ্যই প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অহেতুক দামি গাড়ি কেনা এবং বিদেশ ভ্রমণে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ঠেকাতে সরকারের বিশেষ কমিটিকে একটি ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে হবে।

অন্যদিকে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, মাতারবাড়ী থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পেও একইভাবে ৫ হাজার কোটি বেশি ধরে অনুমোদন নিয়ে লুটপাটের পাঁয়তারা করা হয়েছিল। পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির মুখে তা কাটছাঁটে বাধ্য হয়। একইভাবে মাতারবাড়ী থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রকল্পে অযৌক্তিক ব্যয় ধরে অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অগ্রাধিকারের কথা বলে এভাবে অযৌক্তিক ব্যয়ের প্রকল্প অনুমোদনে নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাসুম আল-বিরুনী জানান, পিজিসিবির নিজস্ব নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সুতরাং এত অর্থ নেয়ার সুযোগ নেই। সব মিলিয়ে অস্বাভাবিক কোনো ব্যয় করা হবে না। সরকারের বিধিবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। কোথাও ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এএম

Link copied!