সড়কপথে যাওয়া যাবে ২৪টি দেশে

এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ

  • বিশেষ প্রতিনিধি     | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২২, ০৯:১১ পিএম
এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ

ঢাকা : স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে শনিবার (২৫ জুন)। আর কালনা সেতু চালু হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে। কাঙ্ক্ষিত এই দুই সেতু চালু হলে আন্তর্জাতিক রুটে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। সড়কপথে যাওয়া যাবে ২৪টি দেশে। 

পদ্মা সেতু চালু হলে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার একটি বাধা দূর হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী।

যানবাহন চালকরা জানান, ফেরিঘাট মানেই ভোগান্তি। কাঙ্ক্ষিত পদ্মা ও কালনা সেতু চালু হলে সেই কষ্ট আর থাকবে না। তবে পদ্মা সেতুর টোলের পরিমাণ কম হলে ভালো হতো। পাশাপাশি কালনা সেতুর টোলের পরিমাণ কম হবে বলে আশা করছেন।
 
সৈয়দ আসলাম আলী জানান, মধুমতী নদীর ওপরই নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা সেতু। এ পর্যন্ত কালনা সেতুর ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে এ সেতুটি নির্মিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘কালনা সেতু’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। 

এ সেতুর পশ্চিমপ্রান্তে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা এবং পূর্বপ্রান্তে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলা। কালনা সেতু চালু হলে বেনাপোল, যশোর, খুলনা, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ঢাকাসহ আশপাশের জেলার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
 
এমনকি এশিয়ান হাইওয়ের আওতায় ভারতের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চালু হবে। এক্ষেত্রে কালনাঘাট থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। ফলে নড়াইল, বেনাপোল, যশোর, খুলনাসহ আশেপাশের সড়ক যোগাযোগ কোথাও ১০০ কিলোমিটার, কোথাও আবার ২০০ কিলোমিটার কমে যাবে। এছাড়া শিল্প শহর যশোরের নওয়াপাড়া এবং মোংলা বন্দর ও সাতক্ষীরা স্থলবন্দরের যোগাযোগ সহজ হবে।

তবে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ‘এক্সপ্রেসওয়ে’ নির্মাণ করা হলেও ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এ ধরনের সড়ক নির্মিত হয়নি। ফলে ‘এক্সপ্রেসওয়ে’র সুফল পাচ্ছে না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি অংশ। ভাঙ্গা থেকে নড়াইল-যশোর- বেনাপোল পর্যন্ত বর্তমানে দুই লেন সড়ক চালু আছে। এই অংশে ‘এক্সপ্রেসওয়ে’ সড়ক নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পাধীন বলে জানিয়েছেন সৈয়দ আসলাম আলী।

মহাসড়কের গুণগত মান উন্নয়নের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ-১) রুটের দৈর্ঘ্য ২০ হাজার ৫৫১ কিলোমিটার। এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ-২) রুটের দৈর্ঘ্য ১৩ হাজার ১৭৭ কিলোমিটার। 

এছাড়া উপআঞ্চলিক এএইচ-৪১ রুট হবে ৭৫৪ কিলোমিটার। এই রুটটি এএইচ-১ নামে পরিচিত। জাপান থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন, ভিয়েতমান, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক হয়ে বুলগেরিয়া সীমান্তে গিয়ে শেষ হবে।
 
বিশেষ করে এএইচ-১ রুটটি বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে যশোর-নড়াইল-কালনা সেতু-ভাটিয়াপাড়া-ভাঙ্গা-পদ্মা সেতু-মাওয়া-ঢাকা হয়ে কাঁচপুর-নরসিংদী- শেরপুর-সিলেট দিয়ে তামাবিল পর্যন্ত ৪৯১ কিলোমিটার সড়কপথ অতিক্রম করবে।

এ বিষয়ে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব আনিসুর রহমান জানান, আন্তর্জাতিকভাবে কয়েকটি সড়ক নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে গেছে। এর মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ে একটি। এছাড়া বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান- ভারত-নেপাল সংযুক্তি) হলো সার্কভুক্ত চারটি দেশ নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি পরিকাঠামো, যেটির উদ্দেশ্য জলের উৎসের সঠিক ব্যবহার এবং বিদ্যুৎ ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

বিমসটেক দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৭টি দেশের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা মূলত বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এবং এর ওপর নির্ভরশীল। বিমেসটেক-এর সাতটি সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো- বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড।

সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) প্রকল্প-২ এর আওতায় এই সড়কের দৈর্ঘ্য টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল ও বগুড়া হয়ে রংপুর পর্যন্ত ১৯০ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এই সড়ক ঢাকা থেকে বগুড়া হয়ে রংপুর পর্যন্ত দ্রুত এবং নিরাপদ যাত্রার পথ সুগম হবে।

বিবিআইএন, বিমসটেক ও সাসেকসহ আরও কয়েকটি রুটে হয়েছে। আন্তর্জাতিক রুটের ক্ষেত্রে পদ্মা ও যমুনা নদী বড় দুটি বাধা ছিল। এই দুটি সেতু যেহেতু হয়ে গেছে। এখন তেমন আর বড় কোন সমস্যা নেই। কালনা সেতু সেপ্টেম্বরে চালু হলে এশিয়ান হাইওয়ের আর কোন মিসিং লিংক থাকবে না। আঞ্চলিক সমস্যার কারণে আন্তর্জাতিক রুটে যুক্ত হতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ বসে নেই। আমাদের সড়ক মান উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, তিনটি রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এশিয়ান হাইওয়েভুক্ত হবে। এর মধ্যে দুটি প্রধান রুট এএইচ-১, এএইচ-২ এবং একটি উপআঞ্চলিক রুট এএইচ-৪১। এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ) রুট-১’র জাপানের টোকিও থেকে তুরস্ক হয়ে বুলগেরিয়া সীমান্তে পর্যন্ত ২০ হাজার ৫৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। এই রুটের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ যুক্ত হবে। এএইচ-১ রুটটি বাংলাদেশের ৪৯১ কিলোমিটার সড়কপথ অতিক্রম করবে।

এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ) রুট-২ এটি ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান হয়ে ইরানের তেহরানের এএইচ-১ রুটের সঙ্গে যুক্ত হবে। এই রুট হবে ১৩ হাজার ১৭৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই রুটের মাধ্যমে ১০ দেশ যুক্ত হবে। এটি বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা সীমান্ত দিয়ে শুরু হয়ে পঞ্চগড়-বেলডাঙ্গা-রংপুর- গোবিন্দগঞ্জ-বগুড়া-হাটিকুমরুল- এলেঙ্গা-কালিয়কৈর- জয়দেবপুর-ঢাকা হয়ে কাঁচপুর-সিলেট দিয়ে তামাবিল পর্যন্ত ৫১২ কিলোমিটার সড়ক বাংলাদেশ দিয়ে অতিক্রম করবে।

এছাড়া উপআঞ্চলিক রুট হিসেবে এশিয়ান হাইওয়ে (এএইচ) ৪১-এ মংলা বন্দর থেকে শুরু হয়ে খুলনা-যশোর-ঝিনাইদহ- কুষ্টিয়া-পাকশী- দাশুরিয়া- বনপাড়া- হাটিকুমরুল- কালিয়াকৈর- জয়দেবপুর- ঢাকা-কাঁচপুর- কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দিয়ে টেকনাফ হয়ে মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৭৫৪ কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করবে।

১৯৯২ সালে বেইজিংয়ে ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দি প্যাসিফিক (এসকাপ) বৈঠকে এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ে ও ল্যান্ড ট্রান্সপোর্ট ফেসিলিটেশন সমন্বয়ে ‘এশিয়ান ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট’ গঠনের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। ২০০১ সালে সিউলের অবকাঠামো কমিটির মন্ত্রীপর্যায়ের সম্মেলনে প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এসকাপের ৫৮তম সম্মেলনে ৩২ দেশের মধ্যে এ বিষয়ে একটি আন্তঃরাষ্ট্র সমঝোতা হয়।

২০০৫ সালের ৪ জুলাই সাংহাইতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৩২ দেশের মধ্যে ২৬টি দেশ স্বাক্ষর করে। এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে আন্তঃদেশীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ২০০৯ সালের ৫ জুলাই। এদিকে এশিয়ান হাইওয়েরভুক্তির জন্য ১৯ প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এক্ষেত্রে সাব রিজিওনাল রোড ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি কারিগরি প্রকল্পের আওতায় সব প্রজেক্টের সম্ভাব্য সমীক্ষা ও ডিটেইলড ডিজাইনের কাজ শেষ হয়েছে। কিছু প্রকল্প নির্মাণ কাজ চরছে। আবার কিছু প্রকল্প অর্থ সংকটে কাজ শুরু করা যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।

কালনা সেতুর বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষক সমিতি নড়াইল জেলা শাখার আহবায়ক খন্দকার শওকত বলেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে কালনা সেতুর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। এ দুটি সেতু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। ফেরিঘাটের অপেক্ষা আর যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না। যাত্রীসাধারণের পাশাপাশি কৃষিপণ্য বেচাকেনার ক্ষেত্রেও সহজ হবে। পাশাপাশি পদ্মা ও কালনাঘাট এলাকায় শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

সুলতান মিয়া নামে এক প্রকৌলশী জানান, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ধারাবাহিকতার বড় সাফল্য পদ্মা সেতু। সেই সঙ্গে কালনা সেতুও। কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও সওজ নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান জানান, কালনা দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) সেতু এটি। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬৫০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১০ মিটার। উভয় পাশে ছয় লেনের সংযোগ সড়ক প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় প্রায় ৯৫০ কোটি টাকা।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!