হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির চার্জশিট শিগগির

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০১৮, ০২:০৭ পিএম
হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির চার্জশিট শিগগির

ঢাকা : রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ২০১৬ সালের ১ জুলাই জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়ের মামলার চার্জশিট চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই তা আদালতে দাখিল করা হবে। তদন্ত সংস্থা নগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় অভিযুক্ত ২২ জনের মধ্যে ১৩ জঙ্গি ইতোমধ্যে র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। আটক ৫ জঙ্গি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এখনো ৪ জঙ্গি পলাতক রয়েছে। এরা হচ্ছে- হাদিসুর রহমান সাগর, মামুনুর রশীদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালিদ ও আকরাম হোসেন নিলয়।

জবানবন্দি : গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে ৫ জঙ্গি। তারা হচ্ছে- রাকিবুল হাসান রিগ্যান, পরিকল্পনাকারী রাজীব গান্ধী, অস্ত্র সরবরাহকারী মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, সংগঠক সোহেল মাহফুজ ও রাশেদুল ইসলাম র‌্যাশ।
 
জবানবন্দিতে তারা বলেছে, মরণপণ জঙ্গি অপারেশনের জন্য গঠিত ইসাবা দলের ৫ সদস্য রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামীহ মোবাশ্বীর, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল জন সিরিয়ায় যাওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়েছিল। তাদের প্রথমে ঢাকার মিরপুর, কল্যাণপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা ও পাবনার জঙ্গি আস্তানায় রাখা হয়েছিল। এরপর নিবরাসসহ কয়েকজনকে ঝিনাইদহে নিয়ে হত্যাকাণ্ডের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিষয়টি তদারক করে হাদিসুর রহমান সাগর। পাঁচজনকে ঢাকায় এনে বুড়িগঙ্গায় গ্রেনেড ছোড়া শেখানো হয়।

২০১৬ সালের মে মাসের শুরুতে জঙ্গিদের নেওয়া হয় গাইবান্ধার যমুনার চরে। ৫ তরুণকে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ দেয় মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, তামিম, মারজান, রিগ্যান, খালেদ, রিপন, রাজীব গান্ধী ও মানিক। প্রধান প্রশিক্ষক জাহিদ একে-২২ রাইফেল ও পিস্তল চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়। হামলার তিন দিন আগে নিবরাস ও রোহান ইমতিয়াজ দলের নেতাদের হলি আর্টিজানের ব্যাপারে তথ্য দেয়। ২৭ জুন তারা মারজানকে নিয়ে হলি আর্টিজান রেকি করে। পরদিন রেকি করে বাশারুজ্জামান, উজ্জ্বল ও পায়েল। ওই রাতেই তামিমসহ নেতারা বারিধারায় তানভীর কাদেরীর বাসায় বসে চ‚ড়ান্ত ছক কষে। তামিম নিজেও হলি আর্টিজান রেকি করে ২৯ জুন সন্ধ্যায় রোহান ইমতিয়াজকে হামলার নেতা নির্বাচিত করে।

এর আগে গুলশানের কাছাকাছি বারিধারায় বাসা ভাড়া নিয়ে তানভীর কাদেরী ২০১৬ সালের ১ জুন সপরিবারে ওই বাসায় ওঠে। ৭ জুন সেখানে ওঠে বাশারুজ্জামান চকলেট। ৮ জুন পাঁচ হামলাকারীকে নিয়ে সেখানে যায় মারজান ও তার স্ত্রী। ১১ জুন যায় তামিম চৌধুরী। পরে মারজান পাঁচটি ব্যাগে পিস্তল, একে-২২ রাইফেল, চাপাতি ও বোমা নিয়ে যায়। ১ জুলাই পর্যন্ত তারা ওই বাসায় ছিল। বড় একটি কক্ষে পাঁচজনকে নিয়ে থাকত তামিম। ৩০ জুন সকালে তানভীর কাদেরীর বাসায় গিয়ে পরদিন হলি আর্টিজানে হামলার চ‚ড়ান্ত ঘোষণা এবং কিছু নির্দেশনা দেয় সরোয়ার জাহান। অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করা হয়েছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর সীমান্ত থেকে। জবানবন্দিতে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান ও রাশেদ ওরফে র‌্যাশ অস্ত্র সরবরাহের কথা স্বীকার করে। রাশেদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে মে মাসে চারটি পিস্তল আনে। সাগর ও ছোট মিজান পাঁচটি একে-২২ রাইফেল আনে একই সীমান্ত দিয়ে। মে মাসে যশোরের চৌগাছা সীমান্ত দিয়ে বোমাগুলো তৈরি অবস্থায় আনে সাগর। হামলার দিন ১ জুলাই সকালে বাশারুজ্জামান প্রত্যেকের ব্যাগে ভরে দেয় একটি করে একে-২২ রাইফেল, পিস্তল, চাপাতিসহ পর্যাপ্ত পরিমাণ গুলি। চারটি গ্রেনেড দেয় দুজনের ব্যাগে। আসরের নামাজের পরপরই দুই ভাগে ভাগ হয়ে পাঁচ হামলাকারী কিছু পথ রিকশায় এবং কিছু পথ হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছে।

জঙ্গি ছাড়াও এ মামলায় কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী তাহমিদ হাসিব খান, তার বান্ধবী ফাইরুজ মালিহা, তাহানা তাসমিয়া, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজাউল করিমের স্ত্রী শারমিনা করিম, ভারতীয় নাগরিক সাত প্রকাশ, কোনো এক জাপানি নাগরিকের গাড়িচালক আবদুর রাজ্জাক রানা, হলি আর্টিজানের নিরাপত্তাকর্মী জসিম, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর কর্মচারী শাহরিয়ার, সহকারী কুক আকাশ খান, ওয়েটার লাজারুস সরেন, সুমন রেজা, সবুজ, শিশির, সুহিন ও সমীর বাড়ৈ প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দেন।

১৩ জঙ্গি নিহত : হলি আর্টিজানে জিম্মি ঘটনার পরদিন সকালে প্যারাকমান্ডোদের অপারেশন থান্ডারবোল্টে নিহত হয় রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামীহ মোবাশ্বীর, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল। পরবর্তী পর্যায়ে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে অভিযানে নিহত হয় জঙ্গি আবু রায়হান তারেক। একই বছরের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় অভিযানে নিহত হয় তামিম আহমেদ চৌধুরী। পরে রাজধানীর রূপনগরে মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম, আজিমপুরে তানভীর কাদেরী, আশুলিয়ায় সরোয়ার জাহান মানিক, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে নূরুল ইসলাম মারজান নিহত হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে অভিযানে নিহত হয় বাশারুজ্জামান চকলেট ও ছোট মিজান।

পলাতক ৪ জঙ্গি : পলাতক চার জঙ্গি হচ্ছে- নব্য জেএমবির অপারেশনাল কমান্ডার হাদিসুর রহমান সাগর, মামুনুর রশীদ রিপন, শরিফুল ইসলাম খালিদ ও পৃষ্ঠপোষক আকরাম হোসেন নিলয়। এদের মধ্যে পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত খালিদ ও রিপন ভারতে পালিয়ে রয়েছে বলে তদন্তকারীদের ধারণা।

আলামত : মামলায় আলামত হিসেবে জব্দ দেখানো হয় ১টি সাদা রুমাল, ৫টি নাইন এমএম পিস্তল, ৩টি একে-২২ মেশিনগান, ১৩টি ম্যাগাজিন, নাইন এমএম ক্যালিবারের ৬টি তাজা গুলি, সেভেন পয়েন্ট সিক্সফাইভ ক্যালিবারের ২৮টি, একে-২২-এর ৩৫টি, পয়েন্ট টুটু বোরের ৪৪টি, ৬ পয়েন্ট ১৬ ক্যালিবারের ১২টি, সেভেন পয়েন্ট সিক্স ক্যালিবারের ২টি গুলি, একই ক্যালিবারের ১৯৫টি গুলির খোসা, নাইন এমএম ক্যালিবারের ১০৫টি গুলির খোসা, ৯টি গ্রেনেড সেফটিপিন, দুটি ছোরা, একটি চাপাতি ও একটি চাকু।

হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডি : ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় ৫ জঙ্গি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জঙ্গিদের গুলি ও গ্রেনেড হামলায় নিহত হন নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন। এ ছাড়া রেস্তোরাঁর ভেতর ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। পরদিন সকালে প্যারাকমান্ডো অভিযানে নিহত হয় ৫ জঙ্গিসহ ৬ জন। হামলার ঘটনায় গুলশান থানায় এসআই রিপন কুমার দাস বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের ওপর। ডিআইজি মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুরো ইউনিট তদন্তে নামে। গত দেড় বছরে তারা বের করে আনে অনেক তথ্য। এসব তথ্যের ভিত্তিতে একদিকে তদন্ত এগোয়, আরেকদিকে চলে অভিযান। সিটিটিসির একের পর এক অভিযানে তছনছ হয়ে যায় জঙ্গিদের ভিত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে দেখা গেছে, হামলার আগে থেকেই তামিম ও মারজান শেওড়াপাড়ার বাসায় ইন্টারনেট অ্যাপসের মাধ্যমে হামলার খবরের অপেক্ষায় থাকে। হামলাকারীরা হত্যাকাণ্ড শেষ করে জিম্মিদের ফোন ও ট্যাব থেকে তামিমকে অ্যাপসে মেসেজ পাঠায়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!